ইয়াবা সাইফুল নিহত, আলোচনায় বদিরা

কালের কণ্ঠ :

দেশে ইয়াবা চোরাকারবারের অন্যতম হোতা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত সাইফুল করিম (৪৫) পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার রাতে কক্সবাজারের টেকনাফ বন্দরের কাছে নাফ নদের তীরে এ ঘটনা ঘটে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ করা ৭৩ জন ইয়াবা কারবারির তালিকায় ২ নম্বরে ছিলেন সাইফুল করিম। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার মাদকসংক্রান্ত একাধিক তালিকায় তাঁর নাম ছিল।

সাইফুল করিম নিহত হওয়ার পর গতকাল শুক্রবার সারা দিন কক্সবাজারের মানুষের মধ্যে আলোচনা ছিল এবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় এক নম্বরে থাকা সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির কী হবে? তাঁরা বলছেন, সাইফুল নিহত হওয়ায় এবার ইয়াবা কারবারে বদি একচ্ছত্র আধিপত্য তৈরি হবে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, পুলিশের জালে আটকা পড়ার পর টানা ছয় দিনের জিজ্ঞাসাবাদে সাইফুল করিম অকপটে স্বীকার করেছেন যে দীর্ঘদিন ধরেই তিনি ও বদি একসঙ্গে ইয়াবা কারবারে জড়িত ছিলেন।

‘বন্দুকযুদ্ধে’ সাইফুল নিহত : পুলিশের দাবি, ইয়াবা গডফাদার সাইফুল করিমকে গত বৃহস্পতিবারই আটক করা হয়েছিল। তবে গত কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে যে সাইফুল গত ২৫ মে মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন থেকে দেশে আসেন। ঈদের পর আত্মসমর্পণ করবেন তিনি।

সে জন্য তিনি পুলিশের ‘নিরাপত্তা হেফাজতে’ ছিলেন।
তবে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পুলিশের সেফহোমে সাইফুলের থাকার বিষয়টি সত্য নয়। তাঁকে পুলিশ গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আটক করতে সক্ষম হয়। পরে তিনি বন্দুকযুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।’

পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, সাইফুলকে আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী বৃহস্পতিবার রাত দেড়টার দিকে পুলিশ তাঁকে নিয়ে টেকনাফ স্থলবন্দরসংলগ্ন নাফ নদের পারে ইয়াবা উদ্ধারে যায়। তখন তাঁর সহযোগীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। গুলিতে টেকনাফ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রাসেল আহমেদ, কনস্টেবল ইমাম হোসেন ও সোলাইমান আহত হন। এরপর আত্মরক্ষার্থে পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলির সময় সাইফুল গুলিবিদ্ধ হন। একপর্যায়ে অবস্থা বেগতিক দেখে মাদক কারবারিরা গুলি করতে করতে পাশের জঙ্গলে পালিয়ে যায়। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে গুলিবিদ্ধ সাইফুল করিমকে উদ্ধার করে টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে পাঠান। সেখানে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়।

টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক প্রণয় রুদ্র সাংবাদিকদের বলেন, গুলিবিদ্ধ সাইফুল করিমকে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আনা হয়। তাঁর শরীরে চারটি গুলির দাগ ছিল। একটি বুকে, তিনটি পেটে। পুলিশ জানিয়েছে, ময়নাতদন্তের জন্য সাইফুলের মরদেহ কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে।

পুলিশ আরো জানিয়েছে, ঘটনাস্থল থেকে ৯টি এলজি, ৪২ রাউন্ড শটগানের তাজা কার্তুজ, ৩৩ রাউন্ড কার্তুজের খোসা এবং এক লাখ ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়েছে।

সাইফুল কক্সবাজারের টেকনাফ পৌরসভার শীলবুনিয়াপাড়ার ডা. মোহাম্মদ হানিফের ছেলে।

এর আগে গত ৩ মে টেকনাফ থানার পুলিশ ১০ হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট, চারটি আগ্নেয়াস্ত্রসহ নিজ বাড়ি থেকে সাইফুল করিমের দুই ছোট ভাই মাহবুবুল করিম ও রাশেদুল করিমকে গ্রেপ্তার করে। তারা বর্তমানে কক্সবাজার জেলা কারাগারে রয়েছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ২০০৩ সালের দিকে সাইফুল টেকনাফ স্থলবন্দরে আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা শুরু করেন। একাধিকবার তিনি সেরা করদাতার (সিআইপি) খেতাব অর্জন করেন। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি টেকনাফ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের কাছে সাড়ে তিন লাখ ইয়াবা, ৩০টি আগ্নেয়াস্ত্রসহ ১০২ জন শীর্ষ ইয়াবা কারবারি আত্মসমর্পণ করলেও সাইফুল তখন বিদেশে আত্মগোপন করেন। তাঁর পরিবারের দাবি, টেকনাফের এক প্রভাবশালী ব্যক্তি আত্মসমর্পণের সুযোগের কথা দিয়ে কয়েক দিন আগে সাইফুল করিমকে মিয়ানমার থেকে টেকনাফে নিয়ে আসেন।

জিজ্ঞাসাবাদে তথ্য প্রদান : টেকনাফ মডেল থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ কালের কণ্ঠকে বলেন, সাইফুলকে আটক করে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এ সময় তিনি বেশ কয়েকজনের নাম পুলিশকে জানিয়েছেন। সাইফুলের স্বীকারোক্তিতে যাদের নাম এসেছে পুলিশ তাদের ব্যাপারে অভিযান শুরু করেছে।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, জিজ্ঞাসাবাদে দেশের অন্যতম শীর্ষ ইয়াবা ডন সাইফুল তাঁর ইয়াবা কারবারের ব্যাপারে অনেক তথ্য দিয়েছেন। এর মধ্যে টেকনাফের সাবেক সংসদ আবদুর রহমান বদি সম্পর্কেও অনেক তথ্য রয়েছে। সাইফুলের দেওয়া তথ্য মতে, টেকনাফ জালিয়াপাড়ার বাসিন্দা জাফর আলম ওরফে টিটি জাফরের মাধ্যমে তিনি ইয়াবার টাকা দুবাই ও সিঙ্গাপুর পাঠাতেন। টিটি জাফরের ভাই টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর মনিরুজ্জামান ও অন্য ভাই আব্দুল গফুর তাঁর ইয়াবা কারবারে সহযোগিতা করতেন। সাইফুল তাঁর ইয়াবার চালান ঢাকায় মো. জুবাইর ও হ্নীলার মাহমুদুল্লাহর কাছে পাঠাতেন বলে পুলিশকে জানান। এ ছাড়া তিনি টেকনাফের পল্লানপাড়ার শামসুল আলম শামসু, তাঁর গাড়িচালক সোনা মিয়া, টেকনাফ এলাকার মৌলভী বোরহান, মৌলভী জহির, বাট্টা আয়ুব, হুন্ডি শওকত, হুন্ডি আনোয়ার, মো. শফি, আলী আহমদ, মোহাম্মদ আমিন, সৈয়দ ও আব্দুল হাফেজ তাঁর ইয়াবা কারবারের অন্যতম সহযোগী বলে পুলিশকে তথ্য দিয়েছেন। এ ছাড়া সাইফুল করিম জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে দেশে ইয়াবা ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর সহযোগী হিসেবে জড়িত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বেশ কয়েকজন সদস্য, রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ করেছেন বলেও জানা যায়।

বদির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা : ইয়াবা ডন সাইফুল করিমকে আটকের পর টেকনাফ সীমান্তের অনেক রথী-মহারথীর ঘুম হারাম হয়ে যায়। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য, সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, পৌর কাউন্সিলর, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও মেম্বারসহ অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি।

সাইফুল করিম ইয়াঙ্গুন থেকে দেশে ফেরার খবর জানাজানি হওয়ার পর থেকে টেকনাফ সীমান্তে সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির কথাই উঠে আসছে বারবার। কারণ বদি প্রথমবার যখন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তখন সাইফুলের ইয়াবা কারবার ছিল তুঙ্গে। তাই বদি হাত মেলান সাইফুল করিমের সঙ্গে। সাইফুল করিমের ইয়াবা কারবারের আয়ের একটি বড় অংশ যেত সংসদ সদস্য বদির কাছে।

সাইফুল করিম ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার পর টেকনাফের লোকজন বলছে, তালিকার এক নম্বরে থাকা সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি, তাঁর ভাই মৌলভী মুজিব, জাফর চেয়ারম্যান, মৌলভী রফিক উদ্দীন ও মৌলভী আজিজ সিন্ডিকেট এখনো অধরা। একসময় তাঁরাও সাইফুলের মতো টেকনাফ সীমান্তের ইয়াবা কারবারের নিয়ন্ত্রক ছিলেন। তাঁরা আত্মসমর্পণও করেননি কিংবা পুলিশের হাতে আটকও হননি। তাঁদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিলে সীমান্তের ইয়াবা কারবার অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে বলে মনে করেন তাঁরা।

স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, সাবেক সংসদ সদস্য বদির ইঙ্গিতেই সাইফুল করিমের ইয়াবা কারবারে ভাগ বসান বদির ভাই টেকনাফ পৌর কাউন্সিলর মৌলভী মুজিবুর রহমান, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমদসহ অনেকেই। বদি ও জাফর পরিবারের প্রায় সদস্য সাইফুলের মাধ্যমে সীমান্তের ইয়াবা কারবারের নিয়ন্ত্রণ নেয় বলে জানা যায়। সে কারণে টেকনাফের লোকজন বলছে, সাইফুল আটকের পর দ্রুত বন্দুকযুদ্ধে মারা যাওয়ায় বদিই সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছেন। কেননা সাইফুল বেশি দিন পুলিশ হেফাজতে থাকলে হয়তো বদি ও ইয়াবা কারবারের জগতের অনেক অজানা তথ্য ফাঁস হয়ে যেত, যা কি না তাঁর জন্য গলার কাঁটা হতো।

জানা যায়, সাবেক সংসদ সদস্য বদির আত্মীয়স্বজন রয়েছেন মিয়ানমারে। অন্যদিকে মোহাম্মদ ইব্রাহিম নামে সাইফুলের এক আপন মামাও রয়েছেন মিয়ানমারে। সেখানে তিনি প্রভাবশালীদের আস্থাভাজন বলে জানা গেছে। এই ইব্রাহিমই নাফ নদের ওপারে স্থাপিত ৩৭টি ইয়াবা কারখানা থেকে সাইফুলের কাছে ইয়াবার চালান পাঠাতেন। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে টেকনাফ এলাকায় ইয়াবার চালানের দেখভাল করতেন বদি ও তাঁর সহযোগীরা। গত দুই দশক ধরে সীমান্ত দিয়ে বদি-সাইফুলের ইয়াবা কারবার চলছিল অবাধে।

২০০৮ সালে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন বদি। এরপর ২০১৪ সালে আবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। এ এক দশক সীমান্তে ইয়াবা কারবারিদের ব্যাপক দাপট ছিল, যার নেপথ্যে ছিলেন বদি।

তবে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত কিছুদিন ধরে সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি ও সাইফুল করিমের মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি হয়। দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা দুজন মিলেমিশে যে কারবার করে আসছিলেন সেই কারবারও ভাগ করে নিয়েছেন। একদিকে বদি সিন্ডিকেট এবং অন্যদিকে সাইফুল সিন্ডিকেটের কারবার চলছে। গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ সাইফুল করিম নিহত হওয়ার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এ নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে। বলাবলি হচ্ছে, সাইফুল নিহতের পর এবার বদি সিন্ডিকেট বেপরোয়াভাবে কারবার চালানোর সুযোগ পেল।

জানা যায়, বদি সিন্ডিকেটের অন্যতম শক্তিধর ব্যক্তি হচ্ছেন তাঁরই ছোট ভাই মৌলভী মুজিবুর রহমান। তিনি টেকনাফ পৌরসভার প্যানেল মেয়র। দীর্ঘদিন ধরে সীমান্তের ইয়াবা কারবারের যাবতীয় কাজ করে আসছেন তিনি। মৌলভী মুজিবুর রহমান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা ৭৩ জন ইয়াবা কারবারির তালিকার ১৫ নম্বরে রয়েছেন। ইয়াবাসংক্রান্ত সংবাদে তাঁর সংশ্লিষ্টতা নিয়ে সংবাদের কারণে স্থানীয় সাংবাদিকরাও তাঁর হয়রানির শিকার।

টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও এলাকার সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী গত রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বদি মনে করেন, ইয়াবা কারবার এলাকার মানুষের জন্য যেন এক বড় পাওনা।’ তিনি আরো বলেন, “বদি টেকনাফের জামেয়া মাদরাসায় এক দিন অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে বলেছেন যে ‘আমি টেকনাফ সীমান্তের ৩০০ ব্যক্তিকে কোটিপতি বানিয়ে দিয়েছি। এটা কি আমার দোষ হতে পারে’?”

টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল বশর বলেন, “এমপি বদি প্রায়ই ইয়াবা কারবারের অহমিকা প্রকাশ করতেন। টেকনাফ উপজেলা পরিষদের একটি সভায় বদি বেশ আনন্দের সঙ্গে বলছিলেন যে ‘আমি এ এলাকার ২০০ যুবককে কোটিপতি করে দিয়েছি। সেই সঙ্গে সাগরপথে মানবপাচারের জন্যও কয়েকটি জেটি করে দিয়েছি। এসব কাজ করে এলাকার লোকজন টাকার মালিক হোক। কে কী বলল তাতে কী আসে যায়।”

টেকনাফের উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আরো বলেন, ‘এমপি বদির পুরো পরিবার যেমনি ইয়াবা কারবারে জড়িত তেমনি ইয়াবা ডন সাইফুল করিমের পরিবারও পুরোটাই জড়িত ইয়াবায়।’

উল্লেখ্য, বদির তিন ভাই গত ১৬ ফেব্রুয়ারি আত্মসমর্পণ করেন। বর্তমানে তাঁরা কারাগারে রয়েছেন।


শেয়ার করুন