ইসলাম সহিষ্ণুতা শেখায়, গালি নয়

43194সিটিএন ডেস্ক:

গুলশানে হামলাকারী দুই জঙ্গি ড. জাকির নায়েকের অনুসারী, এটা জানাজানি হওয়ার পর তোলপাড় সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত সরকার বাংলাদেশে পিস টিভির সম্প্রচার বন্ধ করে দিয়েছে। আমি কখনো পিস টিভি দেখিনি। তাই পিস টিভি বা ড. জাকির নায়েকের ভালো-মন্দত্ব নিয়ে রায় দিতে পারব না। তবে এখন বাংলাদেশে যে জরুরি পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে বিতর্কিত কোনো কিছুকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। তাই পিস টিভি বন্ধের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে আমি একটা লেখা লিখি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো আমিও জানি পিস টিভি বাংলাদেশে খুব জনপ্রিয়। তাই পিস টিভির বিপক্ষে কিছু লেখার ঝুঁকিটা আমি জানতাম। তবুও লিখেছি। লেখার লিঙ্ক ফেসবুকে শেয়ার করার পর এখন পর্যন্ত তিনশরও বেশি মানুষ মন্তব্য করেছেন। প্রায় সব মন্তব্যই পিস টিভির পক্ষে। অনেকে বলেছেন, আমি জাকির নায়েক সম্পর্কে বিস্তারিত না জেনে লিখেছি। এটা সত্যি অভিযোগ। লেখাতেই বলেছি, আমি কখনো পিস টিভি দেখিনি। লেখার আগে ইন্টারনেটে কিছু লিঙ্ক পড়েছি মাত্র। তাই পিস টিভির ভালো-মন্দত্ব নিয়ে আমি কোনো রায় দিইনি। রায় দিয়েছে সরকার, আমি পরিস্থিতি বিবেচনায় তা সমর্থন করেছি।
তবে এটা ঠিক আমার লেখায় জাকির নায়েক সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণাই ছিল। অনেকে বলেছেন, আমার ধারণা ভুল। জাকির নায়েক জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে। তিনি বিনয়ের সাথে, যুক্তি দিয়ে, রেফারেন্স দিয়ে অন্য ধর্মের সাথে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরেন। তার কথা শুনে অনেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। জেনে আমার খুব ভালো লাগছিল, বিশ্বজুড়ে যখন ইসলামবিরোধী প্রচারণার জোয়ার, তখন এমন একজন ইসলাম প্রচারকারীর সত্যিই খুব দরকার। যারা আমার লেখা টুকটাক পড়েন, তারা জানেন, আমি সবসময় ভিন্নমত ও সব ধরনের সমালোচনাকে স্বাগত জানাই। শ্লীলতার সীমা মানলে, আমার ফেসবুকের ওয়াল সবার জন্য উন্মুক্ত। এই লেখার লিঙ্কে আমি সবার মন্তব্য পড়েছি, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বিনয়ের সাথে জবাব দিয়েছি। যেটুকু ভুল, সেটুকু স্বীকার করেছি। আরও জেনে বুঝে লিখতে পারলে ভালো হতো। সবার ভিন্নমতের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই আমি আমার মত ব্যক্ত করেছি। শ্লীলতার সীমা অতিক্রম করায় কয়েকটি মন্তব্য মুছে দিতে বাধ্য হয়েছি। তারপরও আমার স্ট্যাটাসে ৩০৩ জনের মন্তব্য আছে, যার বেশিরভাগই আমার বিপক্ষে এবং গালিগালাজে পূর্ণ।
পিস টিভি বন্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়ে আমি ভুল করেছি, এমন ভাবতে ভাবতেই আমার ভুল ভেঙে যায়। আমি বুঝতে পারি, আমি হয়তো পুরোটা না জেনে করেছি, তবে ভুল করিনি। ড. জাকির নায়েকের অনুসারীরা যে অশ্লীল ভাষায়, যে উগ্র স্টাইলে আমাকে আক্রমণ করেছেন; তা কখনোই ইসলামের শান্তির চেতনার সমান্তরাল নয়। একজন ভালো মুসলমান কখনোই আরেকজনকে গালি দেয় না; কথায় কথায় কাউকে মুনাফিক, অমুসলিম, কাফের বলে গালি দেয় না। ছেলেবেলা থেকে যেটুকু জেনেছি, যেটুকু চর্চা করেছি, মুরুব্বিদের কাছ থেকে যা শুনেছি, যা দেখেছি, যা পড়েছি; তাতে ইসলামকে আমার সত্যিকারের শান্তির ধর্ম মনে হয়েছে। ইসলামে পরমতসহিষ্ণুতা আছে, ভিন্ন মত, ভিন্ন ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা আছে। কিন্তু জাকির নায়েকের অনুসারীরা যে ভাষায়, যে ভঙ্গিতে ভিন্নমতকে মোকাবিলা করার চেষ্টা করেছেন; তা শোভন নয়, শালীন নয়, ইসলামিক তো নয়ই। তবে এ জন্য আমি জাকির নায়েককে দায়ী করতে চাই না। আমি যতটুকু জেনেছি, জাকির নায়েক যুক্তি দিয়ে কথা কথা বলেন। তার বক্তব্য আমার বা আপনার পছন্দ বা অপছন্দ হতেই পারে। কিন্তু তার স্টাইল নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি তার অনুসারীরা তার স্টাইলটি সম্ভবত বুঝতেই পারেননি। আমার স্ট্যাটাসে তাদের অনেকে মন্তব্য শুরুই করেছেন, ছাপার অযোগ্য অশ্লীল গালি দিয়ে। যুক্তি যখন ফুরিয়ে যায়, তখনই মানুষ গালির আশ্রয় নেয়। কিন্তু দুঃখজনক হলো, ইসলামের পক্ষে বলার জন্য যুক্তির অভাব হওয়ার কথা নয়। তার মানে যারা প্রতিপক্ষকে গালি দিচ্ছেন, হেয় করছেন; তারা ইসলামের মূল চেতনাটাই বুঝতে পারেননি। তারা আসলে ইসলামের মর্যাদা তুলে ধরতে পারেননি। জাকির নায়েকের বক্তব্য শুনে নাকি অনেকেই ইসলামের পতাকাতলে সমবেত হয়েছেন। কিন্তু জাকির নায়েকের অনুসারীদের কথা শুনলে মানুষ তাদের কাছ থেকে দূরেই থাকতে চাইবেন। তবে আশা করি, জাকির নায়েকের এমন উগ্র অনুসারীর সংখ্যা বেশি নয়।
হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর চলার পথে এক বুড়ি প্রতিদিন কাঁটা বিছিয়ে রাখতেন। মোহাম্মদ (সা.) তাকে কিছু না বলে প্রতিদিন কাঁটা সরিয়ে চলে যেতেন। একদিন পথে কাঁটা না দেখে মোহাম্মদ (সা.) খোঁজ নিলেন বুড়ি অসুস্থ কিনা। সেই মোহাম্মদ (সা.)-এর অনুসারীরা আজ ইসলামের নামে মুখে গালি, এক হাতে পিস্তল, আরেক হাতে বোমা, গোপন পকেটে চাপাতি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। হায়, আল্লাহ তুমি তাদের সুমতি দাও, হেদায়েত কর।
লেখাটিতে আমি স্বীকার করেছি পিস টিভি আমি কখনো দেখিনি। এই সত্যটা লুকিয়ে যদি আমি লিখতাম, তাহলে অর্ধেক গালি কম খেতাম। অধিকাংশেরই বক্তব্য, পিস টিভি না দেখে জাকির নায়েক সম্পর্কে কীভাবে লিখলাম, লেখা ঠিক হয়নি। দেখে লিখতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু পিস টিভি না দেখলেই যে জাকির নায়েক সম্পর্কে জানা যাবে না, এটা বোধ হয় ঠিক নয়। জাকির নায়েক একজন জনপ্রিয় মানুষ। সারাবিশ্বে তার কোটি কোটি অনুসারী। জাকির নায়েক লিখে গুগলে সার্চ দিলে পড়ার জন্য এতকিছু পাওয়া যাবে, কেউ কয়েকদিন পিস টিভি দেখার সময়ই পাবেন না। অনেকে জাকির নায়েককে মহিমান্বিত করতে গিয়ে তার বিরোধিতাকে ইসলাম বিরোধিতার সাথে গুলিয়ে ফেলেছেন। মানলাম জাকির নায়েক যুক্তি দিয়ে, রেফারেন্স দিয়ে ইসলাম প্রচার করেন। কিন্তু তার সব কথাই যে ইসলামের শেষ কথা, তা যে সব মুসলমানের ভালো লাগবে; এমন তো না-ও হতে পারে। কারণ বিশ্বজুড়ে মুসলমানরা নানা মতে পথে বিভক্ত। শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব তো আছেই। কেউ মাজারে যায়, কেউ যায় না; কেউ মিলাদ পড়ে, কেউ পড়ে না; কেউ সুফিবাদে বিশ্বাস করে; কেউ জিহাদে বিশ্বাস করে। তো এখন জাকির নায়েক মুসলমানদের কোন অংশের প্রতিনিধিত্ব করছেন? জাকির নায়েকের বক্তব্যের বিরোধিতা করলেই কি তাকে তার মুসলমানিত্ব প্রশ্ন তোলা উচিত?
জাকির নায়েকের আবির্ভাবের অনেক আগে থেকেই এ অঞ্চলে ইসলামের বিস্তার ঘটেছে। ঐতিহ্যগতভাবেই বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ, তবে ধর্ম নিয়ে উগ্রতা পছন্দ করে না। অসাম্প্রদায়িক সমাজের স্বপ্ন নিয়ে স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ। এখানে সব ধর্মের মানুষ মিলে-মিশে ধর্ম পালন করে। এই তো সেদিন ঈদের দিনে সিলেটে ঈদের জামাতের নিরাপত্তায় স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করেছে হিন্দু যুবকরা। বাংলাদেশে একই ভবনে মসজিদ এবং মন্দিরের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান রয়েছে। ছেলেবেলা থেকেই আমরা দেখে এসেছি, ইসলামের শান্ত, সৌম্য রূপ। ইসলামের এই চেতনাকেই আমরা সবসময় ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে চাই। এর বিপরীতে যারা বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে ইসলামের নামে ঘৃণা ছড়াচ্ছে, সন্ত্রাস ছড়াচ্ছে, অশ্লীলতা ছড়াচ্ছে; তারা মুসলমান নয়, এত বড় ফতোয়া দেওয়ার যোগ্যতা আমার নেই। ইসলাম আামাকে তেমন শিক্ষা দেয়নি। তবে অবশ্যই তারা ভালো মুসলমান নয়। এরা ইসলামের বন্ধু নয়, শত্রু। তাদের জন্য আমি ঘৃণা ছড়াতে চাই না, ইসলাম ঘৃণা ছড়ায় না। আমি খালি সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি, এরা যেন সত্যিকারের ইসলামে ফিরে আসে। ঘৃণার বদলে, সন্ত্রাসের বদলে, উগ্রতার বদলে, গালির বদলে যেন শান্তির বাণী ছড়ায়।
লেখক : অ্যাসোসিয়েট হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ


শেয়ার করুন