ইসলামে মোজেযা!

download24ডেস্ক রিপোর্ট :

নবীগণ যখনই নিজেদেরকে বিশ্বপ্রভুর প্রেরিত বাণীবাহক হিসেবে পেশ করেছেন তখন লোকেরা তাঁদের কাছে দাবী করেছে, তোমরা যদি সত্যি-সত্যি বিশ্বপ্রভুর প্রতিনিধি হয়ে থাক, তাহলে প্রাকৃতিক নিয়মের প্রচলিত ধারার ঊর্ধে উঠে এমন কিছু অস্বাভাবিক ও অলৌকিক ঘটনা তোমাদের ঘটানো উচিত যা দেখে স্পষ্টতই মনে হবে যে, বিশ্বপ্রভু তোমাদের সত্যতা প্রমাণ করার জন্যে প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের মাধ্যমে এ ঘটনাটা নিদর্শন হিসেবে সংঘটিত করেছেন। এ দাবীর জবাবে নবীগণ কতগুলো নিদর্শন দেখিয়েছেন। কুরআনের পরিভাষায় তাকে আয়াত বা নিদর্শন এবং আকীদা বিশারদগণের পরিভাষায় তাকে মোজেযা বলা হয়েছে।

পূর্ব নবীগণের মোজেযা পর্যালোচনা
হযরত সালেহ (আ)-এর উষ্ট্রীর মোজেযা
“সামুদ জাতির কাছে আমি তাদের ভাই সালেহকে পাঠিয়েছিলাম। সে তাদেরকে বললো, হে আমার স্বজাতিয় ভাইয়েরা! তোমরা আল্লাহর দাসত্ব কর। আল্লাহ ছাড়া তোমাদের কোনো খোদা নেই। তোমাদের কাছে তোমাদের প্রভুর সুস্পষ্ট প্রমাণ উপস্থিত। আল্লহার যমীনে বিচরণ করতে থাক। কোনো খারাপ উদ্দেশ্যে তাকে স্পর্শ কর না। নইলে তোমরা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির কবলে পড়বে”।-(সূরা আ’রাফঃ ৭৩)
বাহ্যিক বাচনভঙ্গি থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, আয়াতের প্রথম অংশে সুস্পষ্ট প্রমাণ ও দ্বিতীয়াংশে নিদর্শন শব্দদ্বয় দ্বারা এ উষ্ট্রীকেই বুঝানো হয়েছে। সূরা শূয়ারার অষ্টম রুকু’তে বিশদভাবে বলা হয়েছে যে, সামুদ জাতি স্বয়ং হযরত সালেহের কাছে নিদর্শন চেয়েছিল, যাতে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, তিনি আল্লাহর নবী। সেই দাবীর জবাবেই হযরত সালেহ উষ্ট্রী হাযির করেছিলেন। সুতরাং উষ্ট্রী যে মোজেযাস্বরূপই এসেছিলেন, তা সন্দেহাতীতভাবে সত্য। অন্যান্য বহু নবী অবিশ্বাসীদের জবাবে আপন নবুয়াতের প্রমাণ হিসেবে যেসব মোজেযা দেখাতেন, এটা সে ধরনেরই একটি মোজেযা। হযরত সালেহ অবিশ্বাসীদেরকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন যে, উষ্ট্রীর বেঁচে থাকার ওপর তোমাদের জীবন নির্ভরশীল। এ হুঁশিয়ারী থেকৈ প্রমাণিত হয় যে, উষ্ট্রীর জন্ম হয়েছিল মোজেযার আকারে। তিনি আরো বলেছিলেন যে, উষ্ট্রী তোমাদের ক্ষেতে অবাধে চরে বেড়াবে। একদিন সে একাকী পানি খাবে। অপর দিন অন্য সকলের জন্তু-জানোয়ার পানি খাবে। তোমরা যদি তার কোনো ক্ষতি কর তাহলে সহসা তোমাদের ওপর খোদার আযাব নেমে আসবে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, জিনিসের অলৌকিকত্ব লোকেরা স্বচক্ষে দেখতে পায়, তাকেই শুধু এমন মর্যাদার সাথে উপস্থাপিত করা যায়। উষ্ট্রীটি যেখানে খুশী চরে বেড়াত এবং একদিন সে একা আর অপর দিন সকেলর জানোয়ার পানি খেত। অবস্থা অনেক দিন চলেছে এবং তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তা বরদাশত করেছে। অবশেষে অনেক সলা-পরামর্শ ও ষড়যন্ত্র করে তাকে মেরে ফেলা হলো। অথচ হযরত সালেহের এমন কোনো শক্তি ছিল না যার জন্যে তাঁকে ভয় করার কিছু ছিল। এ উষ্ট্রীর অলৌকিকত্বের আরও প্রমাণ এই যে, তারা এর জন্যে ভীত-সন্ত্রস্ত ছিল এবং জানত যে, তার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো শক্তি আছে যার বলে সে তাদের মধ্যে অমন স্পর্ধার সাথে ঘুরাফেরা করে। উষ্ট্রীটি কি ধরনের ছিল এবং কিভাবে তার আবির্ভাব ঘটলো, সে সম্পর্কে কুআন ও হাদীসে কোনো স্পষ্ট বিবরণ পাওয়া যায় না। সে জন্যে তাফসীরকারগণ এর জন্ম সম্পর্কে যেসব বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন, তা গ্রহণ করার কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু কুরআন থেকে এ কথা প্রমাণিত যে, উষ্ট্রীটি কোনো না কোনো দিক দিয়ে মোজেযা হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছিল।

মৃতের পুনর্জীবন সংক্রান্ত মোজেযা
“অথবা উদাহরণস্বরূপ সেই ব্যক্তির কথা স্মরণ কর যে একটি বিধ্বস্ত জনপথ অতিক্রম করার সয় বললো, এ মৃত জনপদকে আল্লাহ কি করে পুনরুজ্জীবিত করবেন? আল্লাহ তায়ালা তখন তার প্রাণ সংহার করলেন এবং সে একশ’ বছর পর্যন্ত মৃত অবস্থায় পড়ে রইল। অতপর আল্লাহ তাকে দ্বিতীয় বার জীবন দান করলেন এবং তাকে জিজ্ঞেস করলেন আচ্ছা বলত, তুমি কত দিন মৃত অবস্থায় পড়েছিলে? সে বলল, একদিন বা কয়েক ঘণ্টা। আল্লাহ বললেন, তোমার এ অবস্থার ওপরে একশ’ বছর অতীত হয়েছে। তুমি এখন একটু নিজের খাদ্য ও পানীয়ের দিকে তাকিয়ে দেখ তা মোটেই বিকৃত হয়নি। অন্যদিকে তোমার গাধার দিকেও তাকাও (কার কংকাল পর্যন্ত পচে যাচ্ছে)। তোমাকে লোকদের জন্যে একটা দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরার জন্যেই আমি এসব ঘটিয়েছি। তারপর দেখ আমি কিভাবে এ কংকাল দাঁড় করিয়ে তার মধ্যে রক্ত-মাংস সংযোজন করছি। এভাবে তার কাছে যখন সত্য পরিস্ফুট হয়ে উঠল তখন সে বলল, আমি জানি যে, আল্লাহ সর্বশক্তিমান”।-(সূরা আল বাকারাঃ ২৫৯)
এ ব্যক্তি কে ছিলেন এবং সেটা কোন বস্তি ছিল, তা আলোচনার কোনো প্রয়োজন নেই। আসলে যে জন্যে এ প্রসঙ্গের উল্লেখ করা হয়েছে তা এতটুকু বলার জন্যে যে, যে ব্যক্তি আল্লাহকে নিজের অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করে তাকে তিনি এভাবেই হেদায়াতের আলো প্রদান করেন। ব্যক্তি এবং স্থান নির্ণয়ের কোনো উপায়ও আমাদের হাতে নেই এবং তাতে কোনো লাভও নেই। তবে পরবর্তী বিবরণ থেকে বুঝা যায় যে, যে ব্যক্তি সম্পর্কে এখানে আলোচনা করা হয়েছে তিনি নিশ্চয়ই কোনো নবী ছিলেন।
উপরোক্ত প্রশ্নের অর্থ এ নয় যে, সে বুযর্গ ব্যক্তি পরকাল অবিশ্বাস করতেন অথবা সে সম্পর্কে তাঁর কোনো সন্দেহ ছিল। বরং আসলে তিনি নিগুঢ় তত্ত্বের চাক্ষুস অভিজ্ঞতা লাভ করতে চেয়েছিলেন। নবীদেরকে এ সুযোগ দেয়া হত। দুনিয়ার মানুষ যাকে একশ’ বছর আগে মারা গেছে বলে জানে, সে ব্যক্তির জীবিত হয়ে ফিরে আসা সমসাময়িক লোকদের মধ্যে তাকে একটা জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে যথেষ্ট।
হযরত আইয়ুবের রোগ নিরাময়কারী ঝর্ণা
“আমার বান্দা আইয়ূবের কথা স্মরণ কর। সে তার প্রভুকে সম্বোধন করে বলল, শয়তান আমাকে যন্ত্রণাদায়ক কষ্ট ও আযাবে ফেলে দিয়েছে। (আমি তাকে নির্দেশ দিলাম) মাটিতে পা দিয়ে আঘাত কর। এ হচ্ছে ঠা-া পানি গোসল ও পান করার জন্যে”।-(সূরা সোয়াদঃ ৪১-৪২)
আল্লাহর হুকুমে মাটিতে পদাঘাত করতেই একটা ঝর্ণা বেরিয়ে এল। সেই ঝর্ণার পানি পান ও তা দিয়ে গোসল করাই ছিল হযরত আইয়ুবের রোগের চিকিৎসা। মনে হয়, সম্ভবতঃ হযরত আইয়ুব কোনো মারাত্মক চর্মরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। বাইবেলেও বলা হয়েছে যে, মাথা থেকে পা পর্যন্ত তাঁর সারা শরীর ফোঁড়ায় জর্জরিত ছিল।
হযরত ইবরাহীম (আ)-এর মোযেজা
চারটি পাখী জীবিত করার ঘটনা : “সেই ঘটনাটিও স্মরণ কর, যখন ইবরাহীম বলছেন, খোদা! তুমি কিভাবে মৃতকে জীবিত কর, তা আমাকে দেখাও। আল্লাহ বলেন, তুমি কি বিশ্বাস কর না? ইবরাহীম বলেন, বিশ্বাস তো করি। কিন্তু মনের সন্তুষ্টি প্রয়োজন। আল্লাহ বলেন, তাহলে চারটি পাখি নিয়ে তাদেরকে তোমার পোষ মানিয়ে নাও। তারপর তাদের খ-িত এক একটি অংশ এক একটি পাহাড়ের ওপর রাখ। তারপর তাদেরকে ডাক দাও। তারা তোমার কাছে ছুটে চলে আসবে। জেনে রেখ যে, আল্লাহ অতিশয় পরাক্রমশালী ও নিপুণ কুশলী”।-(সূরা বাকারাঃ ২৬০)
বার্ধক্যে সন্তান লাভ : “অতপর আমি তাকে ইসহাকের এবং ইসহাকে পরে ইয়াকুবের সুসংবাদ দিলাম। সে বলল, হায়! আমার বদ নসীব! আমার সন্তান হবে নাকি? আমি তো খুখুড়ে বুড়ী হয়ে গেছি। আর আমার এ স্বামীও বুড়ো হয়ে গেছেন। এতো বড়ো আজব কথা। ফেরেশতারা বলল, আল্লাহর সিদ্ধান্তে আপনি অবাক হচ্ছেন? হে ইবরাহীমের পরিবারবর্গ! আপনাদের ওপর আল্লাহর রহমত ও বরকত রয়েছে। নিশ্চয়ই আল্লাহ অত্যন্ত প্রশংসনীয় ও বিরাট মর্যাদাশীল”।-(সূরা হুদঃ ৭১-৭৩)
আগুন থেকে হযরত ইবরাহীম (আ) এর নিষ্কৃতি
“তারা পরস্পর বলল, তার জন্যে একটি অগ্নিকু- তৈরী কর এবং জ্বলন্ত আগুণের কু-লীতে তাকে ফেলে দাও। তারা তার বিরুদ্ধে একটা চক্রান্ত এটেছিল। কিন্তু আমি তাদেরকেই হেয় করে দিয়েছি”।-(সূরা আস সাফফাতঃ ৯৭-৯৮)
হযরত মূসা (আ)-এর মোজেযা
“অতপর আমি মূসা ও তার ভাই হারুনকে আমার নিদর্শনসমূহ ও অকাট্য প্রমাণসহ ফেরাউন ও তাঁর দলবলের কাছে পাঠালাম”।-(সূরা আল-মুমিনূনঃ ৪৫-৪৬)
‘নিদর্শনসমূহের’ পর ‘অকাট্য প্রমাণ’ এর উল্লেখের তাৎপর্য এ হতে পারে যে, এসব নিদর্শন তাঁদের সাথে থাকাই দু’জনের নবুয়াতের অকাট্য প্রমাণ ছিল। আবার এও হতে পারে যে, মিসরে তিনি লাঠি ছাড়াআর যেসব মোজেযা দেখিয়েছেন সেগুলো হল নিদর্শন আর অকাট্য প্রমাণ অর্থ তার লাঠি। কেননা লাঠির মাধ্যমে যেসব মোজেযা প্রকাশ পেয়েছে তা তাঁদের উভয়ের রসূল হওয়া সম্পর্কে আর কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকতে দেয়নি।
“তারা যখন নিজেদের যাদুর উপকরণ নিক্ষেপ করল তখন তারা দর্শকদের চোখে যাদু করল এবং মনে ত্রাসের সঞ্চার করল। এভাবে এক সাংগাতিক রকমের যাদু দেখাল। আমি মূসাহে ইংগিত করলাম, তোমার লাঠি নিক্ষেপ কর। লাঠি নিক্ষেপ করতেই তা তাদের মিথ্যা যাদুর মায়াজালকে গ্রাস করতে লাগলো?”(সূরা আরাফঃ ১১৬-১১৭)
হযরত মূসার লাঠি
এরূপ ধারণা করা ঠিক নয় যে, হযরত মূসার লাঠি যাদুকরদের সেই লাঠি ও দড়িগুলোকে গিলে খেয়ে ফেলেছিল যা অজগর সাপের মত দেখাচ্ছিল। কুরআনের বক্তব্য শুধু এইযে, মূসার লাঠি সা প হয়ে যাদুকরদের ধোঁকাপূর্ণ মায়া মরীচিকা গ্রাস করে ফেলল। আয়াতের মর্ম স্পষ্টতঃ এ রকম মনে হয় যে, মূসার সাপ যেদিকে যেদিকে গেছে, সেখাণ থেকে যাদুর প্রভাব নষ্ট হয়ে গেছে। যাদুর প্রভাবে যাদুকরদের লাঠি ও দড়ি সাপের মত ফণা তুলছিল বলে দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু মূসার সাপ এক চক্কর ঘুরে আসতেই সকল লাঠি লাঠির রূপ এবং সকল দড়ি দড়ির রূপ ধারণ করল।
ফেরাউন গোষ্ঠীর ওপর বিভিন্ন সতর্কতামূলক আযাব
“আমি ফেরাউনের লোকজনকে কয়েক বছর পর্যন্ত দুর্ভিক্ষ ও ফসলহানিতে আক্রান্ত করেছিলাম যাতে করে তাদের সন্বিৎ ফিরে আসে। কিন্তু তাদের এমন দশা হয়েছিল যে, ভাল অবস্থা হলে বলত, আমরা এর যোগ্য। আর খারাপ কিছু ঘটলে মূসা ও তার সাথীদেরকে তাদের জন্যে দুর্ভাগ্যজনক মনে করত। আসলে তাদের দুর্ভাগ্য আল্লাহর কাছেই ছিল। তবে তাদের অধিকাংশেরই তা জানা ছিল না। তারা মূসাকে বলল, তুমি আমাদেরকে যাদু প্রভাবিত করার জন্যে যে নিদর্শনই নিয়ে আস না কেন আমরা তোমার কথা শুনব না। শেষ পর্যন্ত আমি তাদের ওপর ঝড়-ঝঞ্ঝা প্রভাবিত করলাম, পঙ্গপাল ছড়িয়ে দিলাম উই পোকা ও ব্যাঙ পাঠিয়ে দিলাম এবং রক্তবৃষ্টি বর্ষণ করলাম। এসব নিদর্শন আলাদা আলাদাভাবে দেখালাম। কিন্তু তারা দাম্ভিকতার পথে এগিয়েই যেতে লাগল। আসলে তারা ছিল ভীষণ অপরাধী জাতি”।-(সূরা আল আ’রাফঃ ১৩০-১৩৩)
যে জিনিস কিছুতেই যাদুর ফল হতে পারে না বলে ফেরাউনের সভাসদগণের নিশ্চিতরূপে জানা ছিল, তাকেও যাদু বলে আখ্যায়িত করে তারা হঠকারিতা ও বাকচাতুরি প্রদর্শন করেছে। সারা দেশে দুর্ভিক্ষ ও ক্রমাগত ফসলহানি ঘটানো যে কোন যাদুকরের কৃতিত্ব হতে পারে, তা বোধ হয় কোনো নির্বোধ বিশ্বাস করবে না। এ কারণেই কুরআনে বলা হয়েছেঃ
“আমার নিদর্শনগুলো যখন তারা দেখতে পেল তখন বলল, এটা নিশ্চয়ই সুস্পষ্ট যাদু। অথচ ভেতর থেকে তাদের মন বিশ্বাসী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু নিছক দাম্ভিকতা ও অংকার বশেই তারা অস্বীকার করলো”।-(সূরা আন নামলঃ ১৩-১৪)
পূর্বোক্ত আয়াতে যে ঝড়-তুফানের কথা বলা হয়েছে, তা সম্ভবত শিলাবৃষ্টিসহ প্রবল বারিবর্ষণ ছিল। তুফান অন্য ধরনেরও হতে পারে। তবে বাইবেলে তুষারাপাতজনিত তুফানের উল্লেখ করা হয়েছে। তাই আমি এ অর্থই ব্যবহার করেছি।
ঐ আয়াতে যে ‘কুম্মাল’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে তার কয়েকটি অর্থ রয়েছে, যথাঃ উকুন, ক্ষুদে পংগপাল, মশা, উইপোকা ইত্যাদি। এমন ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ প্রয়োগের কারণ সম্ভবত এই যে, মশা ও উকুন মানুষের ওপর এবং উই পোকা খাদ্য-গুদামে হামলা চালিয়েছিল।-(বাইবেলের যাত্রাপুস্তক, ৭ম থেকে ১২শ অধ্যায় দ্রষ্টব্য)
নয়টি নিদর্শন
“আমি মূসাকে নয়টি সুস্পষ্ট নিদর্শন দিয়েছিলাম। এখন তুমি নিজেই বনী ইসরাঈলকে জিজ্ঞেস কর যে, মূসা যখন তাদের সামনে এসেছিল তখন ফেরাউন তাঁকে কি বলেছিল যে, হে মূসা, আমি মনে করি তোমাকে অবশ্যই যাদু করা হয়েছে। মূসা তার জবাবে বলল, এসব মনোজ্ঞ নিদর্শন আসমান-যমীনের প্রভু ছাড়া আর কেউ নাযিল করেনি। হে ফেরাউন। আমার ধারণা যে তুমি নিশ্চয়ই হতভাগ্য”।-(সূরা বনী ইসরাঈলঃ ১০১-১০২)
সূরা আল আ’রাফে এ নয়টি নিদর্শনের উল্লেখ করা হয়েছে। সেগুলো হলঃ ১. লাঠি -যা সাপে রূপান্তরিত হত ২. উজ্জল হস্ত -যা বগল থেকে বের করে আনলেই সূর্যের মত আলো-ঝলমল করত ৩. যাদুকরদের যাদুকে জনসাধারণ্যে পরাজিত করা ৪. একটি ঘোষণা অনুসারে সারাদেশে দুর্ভিক্ষ হওয়া ৫. ক্রমাগত তুফান ৬. পঙ্গপাল ৭. উইপোকা ৮. ব্যাঙ ও ৯. রক্ত প্রভৃতি বিপদসমূহ অবতীর্ণ হওয়া।
হযরত মূসা ফেরাউনের কথার যে জবাব দেন, তার মর্ম ছিল এই যে, দেশব্যাপী দুর্ভিক্ষ লক্ষ লক্ষ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে ব্যাঙের উৎপাত, সমস্ত খাদ্যগুদামে উই পোকার আক্রমণ এবং এ ধরনের অন্যান্য জাতীয় সংকট কোনো যাদুকরের যাদু অথবা কোনো মানবীয় শক্তির দ্বারা সংঘটিত হতে পারে না। এখানে স্মরণ রাখা দরকার যে, প্রত্যেক বিপদ আসার আগে হযরত মূসা ফেরাউনকে সাবধান করে দিয়ে বলতেন, তুমি যদি নিজের হঠকারিতা ত্যাগ না কর, তাহলে এই এই বিপদ তোমার রাজ্যের ওপর চাপেয়ে দেয়া হবে। তার কথা মত ঠিক সেই বিপদ যথাসময়ে এসে পড়তো। এমতাবস্থায় এসব বিপদাপদ আসমান-যমীনের মালিক আল্লাহ ছাড়া আর কারও দ্বারা সংঘঠিত হয়েছে -এ কথা বলা একমাত্র কোনো পাগল বা হঠকারী ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব।
লাঠি দ্বারা সাগরকে দ্বিখ-িত করা
“আমি মূসাকে অহী দ্বারা বললাম, এখন তুমি আমার বান্দাদেরকে নিয়ে রাতারাতি বেরিয়ে পড় এবং তাদের জন্যে সমুদ্রের ভেতর শুকনো রাস্তা বানিয়ে দাও। তোমাদের পেছনে কেউ ধাওয়া করছে সে ভয় কর না। আর (সমুদ্রের ভেতর দিয়ে চলতে গিয়ে ঘাবড়ে যেও না”।-(সূরা ত্বাহাঃ ৭৭)
এ ঘটনার বিবরণ এই যে, আল্লাহ তায়ালা শেষ পর্যণ্ত একটা রাত নির্দিষ্ট করে দিলেন যে রাতে সকল ইসরাঈলী ও অইসরাঈলী মুসলমানদেরকে (যার জন্যে “আমার বান্দাগন” এ ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে) সকল অঞ্চল থেকে হিজরত করে বেরিয়ে পড়ার কথা। আগে থেকে নির্ধারিত একটা জায়গায় তাঁরা সবাই একত্র হয়ে একটা কাফেলার আকারে বেরিয়ে পড়লেন। সে কালে সুয়েজ খাল ছিল না। লোহিত সাগর থেকে ভূমধ্য সাগর পর্যন্ত সমগ্র এলাকা ছিল মুক্ত এলাকা। কিন্তু সে এলাকার সমস্ত পথে সামরিক ঘাটি ছিল। এ জন্যে ঐ রাস্তা অতিক্রম করা নিরাপদ ছিল না। এ জন্যে হযরত মূসা লোহিত সাগর অভিমুখী পথ অবলম্বন করেন। সম্ভবত সমুদ্রের তীর ধরে সিনাই উপদ্বীপের দিকে বেরিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা তাঁর ছিল। কাফেলা সমুদ্রতীরে থাকতেই ওদিকে পেছন থেকে ফেরাউনের বিরাট বাহিনী এসে পৌঁছে গেল। সূরা শুয়ারাতে বর্ণিত হয়েছে যে, মোহাজেরদে কাফেলা সমুদ্র ও ফেরাউনের বাহিনীর মধ্যস্থলে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। ঠিক সেই মুহুর্তে আল্লাহ হযরত মূসাকে নির্দেশ দেন ‘তোমার লাঠি দিয়ে সমুদ্রের ওপর আঘাত কর’। তৎক্ষনাৎ সমুদ্র দ্বিখ-িত হল এবং তার দু’ভাগ দু’দিকে মস্তবড় পাহাড়ের মত উঁচু হয়ে দাঁড়ালো’। কাফেলা পার হয়ে যাওয়ার জন্যে মাঝখানে শুধু রাস্তা হয়ে গেল তাই নয় বরং মধ্যবর্তী এ অংশটি একটা শুষ্ক সড়কে পরিণত হল। এ হল একটা সুস্পষ্ট মোজেযারই বর্ণনা। যারা বলেন, ঝড় কিংবা জোয়ার-ভাটার কারণে সমুদ্রের পানি সরে গিয়েছিল, তাদের কথা এ বর্ণনা থেকে অসার প্রমাণিত হয়। কেননা সে কারণে পানি সরলে তা দু’পাশে পাহাড়ের মত উঁচু হয়ে দাঁড়ায় না এবং মাঝের অংশ শুকনো সড়কে পরিণত হয় না।
“আমি মূসাকে অহীর মাধ্যমে নির্দেশ দিলাম, তুমি সমুদ্রের ওপর লাঠি দিয়ে আঘাত কর। তৎক্ষণাৎ সমুদ্র দু’ভাগ হয়ে গেল এবং দু’ভাগ দু’দিকে মস্তবড় পাহাড়ের মত উঁচু হয়ে দাঁড়াল”।-(সূলা শূয়ারাঃ ৬৩)
আরবী ভাষায় মানে পাহাড়। লিছানুল আরব নামক অভিধান গ্রন্থে বলা হয়েছে মানে বিরাটকায় পাহাড়। এর ওপর আবার তথা ‘বিরাট’ বিশেষণ প্রয়োগ করার অর্থ দাঁড়ায় এই যে, পানি উভয় দিকে অত্যন্ত উঁচু পাহাড়ের আকারে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সমুদ্রের ভেতর দিয়ে এই যে রাস্তার ব্যবস্থা, এটা একদিকে বনী ইসরাঈলের কাফেলার পার হওয়ার সুযোগ করে দেয়া এবং অপরদিকে ফেরাউনের বাহিনীকে ডুবিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যেই করা হয়েছিল। এর থেকে পরিস্কার বুঝা যায় যে, পানি এত বড় উঁচু পাহাড়ের আকারে এত দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড়িয়েছিল যে, লক্ষ লক্ষ ইসরাঈলী মোহাজেরদের কাফেলা তার ওপর দিয়ে পারও হয়ে গেল, আবার তাদের পর ফেরাউনের বাহিনী তার মাঝখান পর্যন্ত পৌঁছেও গেল। এ কথা বলাই নিষ্প্রয়োজন যে, সাধারণ প্রাকৃতিক নিয়মের অধীন যেসব ঝড়ো হাওয়া প্রবহিত হয়, তা যত প্রচ-ই হোক না কেন, তার দরুন সমুদ্রের পানি এত বড় পাহাড়ের মত হয়ে এত দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকে না। আরও লক্ষ্য করার ব্যাপার এই যে, সূরা ত্বাহায় বলা হয়েছে ‘তাদের জন্যে সমুদ্রের মধ্যে শুকনো রাস্তা বানিয়ে দাও’। অর্থাৎ সমুদ্রের ওপর লাঠি দেয় আঘাত করায় শুধু যে পানি সরে গিয়ে দু’দিকে পাহাড়ের মত দাঁড়াল তা নয়, বরং ভেতরে যে রাস্তা হলো তা শুষ্ক হয়ে গেল। বিন্দুমাত্র কাঁদা পানি রইল না যে, চলাচলে ব্যঘ্যাত সৃষ্টি হতে পারে। এটা একটা সুস্পষ্ট মোজেযার বর্ণনা। সাধারণ প্রাকৃতিক নিয়মের অধীন এ ঘটনা ঘটেছিল বলে যারা এর ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করেন, তাদের ধারণা যে ভ্রান্ত তা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
‘মান্না’ ও ‘সালওয়া’
“আমি তোমাদের ওপর মান্না ও সালওয়া নাযিল করেছি”।-(সূরা ত্বাহাঃ ৮০)
বাইবেলের বিবরণ এই যে, মিসর থেকে বেরিয়ে আসার পর যখন বনী ইসরাঈল সীন মরুভূমিতে এলিম ও সিনাই এর মাঝখানে পথ অতক্রম করছিল এবং খাদ্য ভা-ার নিঃশেষ হয়ে যাওয়ায় তাদের অনাহারে কাটানো উপক্রম হয়েছিল, তখন মান্না ও সালওয়া নাযিল হওয়া শুরু হয় এবং ফিলিস্তিনের লোকালয়ে পৌঁছা পর্যন্ত দীর্ঘ চল্লিশ বছর এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। (যাত্রাপুস্তক অধ্যায়-১৬, গণনাপুস্তক অধ্যায়-১১ স্ত্রোত্র ৭-৯, যিহোশয়ের পুস্তক, অধ্যায়-৫, স্তোত্র ১২) যাত্রাপুস্তকে মান্না ও সালওয়ার বিবরণ প্রসঙ্গে বলা হয়েছেঃ “পরে সন্ধ্যাকালে ভারুই পক্ষী উড়িয়া আসিয়া শিবিরস্থান আচ্ছাদন করিল, এবং প্রাতঃকালে শিবিরের চারিদিকে শিশির পড়িল। পরে পতিত উর্দ্ধগত হইলে, দেখ, ভূমিস্থিত নীহারের ন্যায় সরু বীজাকার সূক্ষ্ম বস্তুবিশেষ প্রান্তরের উপরে পড়িয়া রহিল। আর তাহা দেখিয়া ইস্রায়েল সন্তানগণ পরস্পর কহিল, উহা কি? কেনননা তাহা কি, তাহারা জানিল না। তখন মোশি কহিলেন, উহা সেই অন্ন, যাহা সদাপ্রভু তোমাদিগকে আহারার্থে দিয়েছেন।-(অধ্যায় ১৬, স্তোত্রঃ ১৩-১৫)
আর ইস্রায়েল-কুল ঐ খাদ্যের নাম মান্না রাখিল; তাহা ধনিয়া বীজের মত, শুক্ল-বর্ণ, এবং তাহার আস্বাদ মধুমিশ্রিত পিষ্টকের ন্যায় ছিল।-(স্তোত্রঃ ৩১)
গণনাপুস্তকে এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আরও বলা হয়েছেঃ
লোকেরা ভ্রমণ করিয়া তাহা কুড়াইত, এবং যাঁতায় পিষিয়া কিম্বা উখলিতে চূর্ণ করিয়া বহুগুণাতে সিদ্ধ করিত, ও তদ্দারা পিষ্টক প্রস্তুত করিত; তৈলপক পিষ্টকের ন্যায় তাহার আস্বাদ ছিল। রাত্রিতে শিবিরের উপরে শিশির পড়িলে ঐ মান্না তাহার উপরে পড়িয়া থাকিত।-(অধ্যায়-১১, স্তোত্রঃ ৮-৯)
এটাওএকটা মোজেযা ছিল। কেননা চল্লিশ বছর পর যখন বনী ইসরাঈল স্বাভাবিক খাদ্য পাওয়া শুরু করল, তখন এ প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেল। আজকাল সেখানে বটের নামক পাখীরও আধিক্য দেখা যায় না, আর মান্নাও কোথাও পাওয়া যায় না। সন্ধানী লোকেরা বনী ইসরাঈলের চল্লিশ বছর ব্যাপী মরুচারী জীবন যাপনের ঐ এলাকাটায় তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখেছে, মান্না তারা কোথাও পায়নি। অবশ্য ব্যবসায়ী লোকেরা মানুষকে বোকা বানাবার জন্যে ‘মান্না’ এর হালুয়া বিক্রি করে বেড়ায়।
হযরত সুলায়মান (আ) এর মোজেযা
“এবং তিনি বললেন, হে জনগণ! আমাকে পাখির ভাষা শিখানো হয়েছে”।-(সূরা আন নামলঃ ১৬)
হযরত সুলায়শান পশুপাখির ভাষা সম্পর্কে জ্ঞান রাখতেন এ বিষয়ে বাইবেল নীরব। তবে ইসরাঈলী কিংবদন্তিতে এ সম্পর্কে স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে।-(জিউরিশ ইনসাইক্লোপেডিয়া, ১১শ’ খ-, পৃষ্ঠা ৪৩৯)
জ্বিনেরা তাঁর অনুগত ছিল
“সুলায়মানের জন্যে জ্বিন, মানুষ ও পাখির সুনিয়ন্ত্রিত বাহিনীর সমাবেশ করা হয়েছিল”।-(সূরা আন নামলঃ ১৭)
সাবার রাণীর সিংহাসন এক নিমিষে হাযির করা হয়েছিল
“সুলায়মান বললেন, হে সভাসদবৃন্দঃ আনুগত্য স্বীকার করে আমার কাছে চলে আসার আগে রাণীর সিংহাসন আমার কাছে কে এনে দিতে পারে? এক দানব বলল, আপনি যেখানে বসে আছেন ওখান থেকে উঠবার আগেই আমি তা এনে দেব, আমি এ ব্যাপারে ক্ষমতাবান ও বিশ্বস্ত। কিতাব সম্পর্কিত জ্ঞানের অধিকারী একজন বলল, আমি চোখের পলকেই তা এনে দেব। অতপর যখন সুলায়মান সে সিংহাসন নিজের কাছে দেখতে পেলেন, তখন বলে উঠলেন, এটা আমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ”।
ইউনুস (আ)-এর ঘটনার অলৌকিক দিক
“নিশ্চয়ই ইউনুসও একজন রসূল ছিলেন। সেই সময়টা স্মরণ কর, যখন তিনি একটা যাত্রী বোঝাই জাহাজের দিকে ছুটে পালালেন। লটারীতে অংশগ্রহণ করে পরাজিত হলেন। অবশেষে তাকে মাছে গিলে ফেলল। তিনি ছিলেন অনুতপ্ত। তিনি যদি আল্লাহর তসবীহ পাঠকারী না হতেন তাহলে কেয়ামত পর্যন্ত তাকে সেই মাছের পেটেই থাকতে হত। অবশেষে তাকে আমি খুবই রুগ্ন অবস্থায় একটা গাছপালাহীন প্রান্তরে নিক্ষেপ করলাম এবং তার ওপর একটা লাউ গাছ জন্মিয়ে দিলাম”।-(সূরা আস সাফফাতঃ ১৩৯-১৪৬)
বৃদ্ধা স্ত্রীর গর্ভ থেকে হযরত যাকারিয়ার সন্তান লাভ
“তুমি অনুগ্রহ করে আমাকে একজন উত্তরাধিকারী দাও। যেন সে আমারও উত্তরাধিকারী হয় এবং ইয়াকুবের বংশধরেও উত্তরাধিকার লাভ করে। আর হে আমার রব! তাকে একজন মনোনীত মানুষ হিসেবে তৈরী কর। হে যাকারিয়া! আমি তোমাকে একটি সন্তানের সুসংবাদ দিচ্ছি যার নাম হবে ইয়াহইয়া। আমি ইতিপূর্বে এ নামে আর কোনো মানুষ সৃষ্টি করিনি। তিনি বললেন, হে আমার রব! আমার স্ত্রী তো বন্ধ্যা। আর আমিও চরম বাধ্যক্যে উপনীত। কি করে আমার সন্তান হবে? জবাব এলঃ এটাই হবে। তোমার রব বলেছেন, এটা আমার জন্যে একেবারেই তুচ্ছ ব্যাপার। এর আগে তোমাকেও আমি সৃষ্টি করেছি। তখন তোমার কোনো অস্তিত্বই ছিল না। যাকারিয়া বললেন, হে প্রতিপালক! আমার জন্যে একটা নিদর্শন ঠিক করে দিন। আল্লাহ বললেন, তোমার জন্যে নিদর্শন এই যে, পর পর তিন দিন তুমি লোকদের সাথে কথা বলতে পারবে না”।-(সূরা মরিয়মঃ ৫-১০)
হযরত ঈষা (আ)-এর মোজেযা
হযরত ঈসার বিনা বাপে জন্ম লাভ :“মরিয়মকে ও তার ছেলেকে আমি একটা নিদর্শন বানালাম এবং উভয়কে একটা উঁচু জায়গায় রাখলাম যেখানে তারা স্বস্তি লাভ করেছিল এবং যেখানে ঝর্ণাসমূহ প্রবাহিত ছিল”।-(সূরা মুমিনুনঃ ৫০)
এখানে এ কথা বলা হয়নি যে, মরিয়ম একটা নিদর্শন ছিল এবং মরিয়মের ছেলে আর একটা নিদর্শন ছিল। এ কথাও বলাহ য়নি যে, মরিয়ম ও তার ছেলেকে দু’টো নিদর্শনে পরিণত করেছি। বরং উভয়ের সমন্বয়ে একটা নিদর্শন বানান হয়েছে -এ কথাই বলা হয়েছে। এর তাৎপর্য এই যে, বাপ ছাড়া ঈসা (আ)-এর জন্ম হওয়া এবং পুরুষের সংসর্গ ছাড়া মরিয়মের গর্ভবতী হওয়াটাই মা ও ছেলের একত্রে একটি নিদর্শনে পরিণত হওয়ার কারণ।
“(আর হে মুহাম্মদ!) তুমি এ গ্রন্থে মরিয়ামের সেই ঘটনা বর্ণনা কর, যখন সে আপনজন থেকে আলাদা হয়ে পূর্ব নির্জনবাস গ্রহণ করেছিল। সে পর্দায় আচ্ছাদিত হয়ে তাদের থেকে লুকিয়েছিল। সে অবস্থায় আমি তার কাছে আপন আত্মা (ফেরেশতা)-কে পাঠালাম। সে তার কাছে পূর্ণ মানবীয় রূপে দেখা দিল। মরিয়ম (ফেরেশতা)-কে পাঠালাম। সে তার কাছে পূর্ণ মানবীয় রূপে দেখা দিল। মরিয়ম হঠাৎ বলে উঠলঃ তুমি যদি কোনো খোদাভীরু লোক হয়ে থাক তবে আমি তোমার থেকে দয়ামত খোদার আশ্রয় প্রার্থনা করি। সে বলল, আমি তোমার রবের দূত মাত্র। তোমাকে একটা পবিত্র সন্তান দান করবো, এ উদ্দেশ্যে এসেছি। মরিয়ম বলল, আমার ছেলে হবে কেমন করে? আমাকে তো কোনো পুরুষ মানুষ স্পর্শও করেনি, আর আমি কোনো চরিত্রহীন মেয়েলোকও নই। ফেরেশতা বলল, এমনিই হবে। তোমার রব বলেছেনঃ এ কাজ আমার পক্ষে খুবই সহজ। আমি এ ছেলেটিকে মানবম-লীর জন্যে একটা নিদর্শন এবং নিজের পক্ষ থেকে এক অনুগ্রহে পরিণত করার উদ্দেশ্যেই এ কাজ করব। আর এটা আল্লাহর সিদ্ধান্তকৃত বিষয়, এটা হবেই। মরিয়ম সেই সন্তানটিকে গর্ভে ধারণ করল এবং দূরবর্তী স্থানে চলে গেল। অতপর প্রসব বেদনা তাকে এক খেজুর গাছের নীচে যেতে বাধ্য করল। সে বলতে লাগলঃ হায় এর আগে যদি আমার মরণ হত এবং আমার নাম-নিশানা না থাকত”।-(সূরা মরিয়মঃ ১৬-২৩)
এখানে দূরবর্তী স্থান অর্থে বেথলেহেমকে বুঝানো হয়েছে। হযরত মরিয়মের ই’তেকাফ থেকে বেরিয়ে সেখানে যাওয়া একটা স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। মরিয়ম একেতো ছিলেন বনী ইসরাঈলের সবচেয়ে ধার্মিক গোষ্ঠী বনী হারুনের বংশধর, তার ওপর আবার আল্লহার ইবাদাতের জন্যে নিবেদিতা হয়ে বায়তুল মাকদাসে অবস্থান করছিলেন। এমন মেয়ে হঠাৎ গর্ভবতী হয়ে পড়লেন। এ অবস্থায় তিনি যদি ই’তেকাফের জায়গায় বসে থাকতেন এবং তাঁর গর্ভের ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যেত তাহলে পরিবারের লোকেরা তো বটেই, তাঁর স্বজাতির অন্যান্য লোকেরাও তাঁর জবিন দুর্বিসহ করে তুলত। বেচারী এ কঠিন মুসিবতে পড়ে নিশব্দে ই’তেকাফের কক্ষ ত্যাগ করে বেরিয়ে পড়লেন যাতে করে আল্লাহর ইচ্ছা পূর্ণ হওয়িার মুহুর্তটা পর্যন্ত অন্ততঃ স্বজাতির ধিক্কার-তিরস্কার ও ব্যাপক দুর্নাম থেকে বেঁচে থাকতে পারেন। এ বেরিয়ে পড়ার ঘটনাটি হযরত ঈসার বিনা বাপে পয়দা হওয়ার জ্বলন্ত প্রমাণ। মরিয়ম যদি বিবাহিত হতেন এবং স্বামী থেকেই তাঁর গর্ভধারণ হত তাহলে পিত্রালয় ও শ্বশুরালয় ছেড়ে সন্তান প্রসবের জন্যে একটা দূরবর্তী স্থানে চলে যাওযার কোনো কারণই ছিল না।
‘হায়, যদি আমার মরণ হত এবং আমার নাম-নিশানা না থাকতো’ -মরিয়মের এ উক্তি থেকেই বুঝা যায়, তিনি তখন কতখানি উদ্বিগ্ন ও দুশ্চিন্তাগ্রস্তা ছিলেন। অবস্থার নাজুকতা উপলব্ধি করলে সে কথা কারোই বুঝতে কষ্ট হয় না যে, কেবল প্রসব বেদনার দরুন তাঁর মুখ দিয়ে এ কথা বের হয়নি বরং আল্লাহ যে ভয়াবহ অগ্নিপরীক্ষায় তাঁকে ফেলেছিলেন তাতে কি করে তিনি ভালভাবে উত্তীর্ণ হবেন, এ চিন্তাই তাঁকে অস্থির করে রেখেছিল। গর্ভে সন্তান থাকার ব্যাপারটা না হয় এ যাবত কোনো না কোনো উপায়ে তিনি লুকিয়ে রেখেছেন। কিন্তু এখন এ সন্তানকে নিয়ে যাবেন কোথায়? মরিয়ম যে এ কথাগুলো বলেছিলেন তা পরবর্তী এ কথা থেকে প্রমাণিত হয় যখন ফেরেশতা তাঁকে বললেন, তুমি চিন্তিত হয়ো না। বিবাহিত মেয়ের প্রসবকাল উপস্থিত হলে কষ্টের দরুন সে যতোই ছটফটই করুক না কেন, সে কখনো চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন হয় না।
দোলনায় সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর কথা বলা
“যে যখন বাচ্ছাকে কোলে নিয়ে নিজের লোকজনের কাছে এলো তখন লোকেরা জিজ্ঞেস করল, হে মিরয়ম! তুমি এ কোত্থেকে নিয়ে এলে? হে হারুনের বোন! না তোমার বাপ খারাপ লোক ছিল, আর না তোমার মা চরিত্রহীনা ছিল”।-(সূরা মরিয়মঃ ২৭-২৮)
যারা হযরত ঈসার অলৌকিক জন্ম অস্বীকার করে তাদের কাছে এর কি ব্যাখ্যা আছে যে, হযরত মরিয়ম যখন বাচ্চা কোলে নিয়ে এলেন তখন তাঁর জাতির লোকজন ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁকে নানারূপে তিরস্কার-ভর্ৎসনা করতে লাগল কেন?
“মরিয়ম তার বাচ্চার দিকে ইঙ্গিত করলে লোকেরা বললো, দোলনায় শায়িত শিশুর সাথে আমরা কি কথা বলবো”।-(সূরা মরিয়মঃ ২৯)
কুরআনের বিকৃত ব্যাখ্যাকারীগণ আয়াতটির অর্থ এরূপ করেছেন -“যে কালকের শিশু তার সাথে আমরা কি কথা বলবো?” অর্থাৎ তাদের মতে এসব কথাবার্তা হযরত ঈসার যৌবনকালে হয়েছে। বনী ইসরাঈলের বয়স্ক ও বুড়ো লোকেরা বলেছিল, ‘যে ছেলেকে সেদিন আমরা দোলনায় পড়ে থাকতে দেখলাম তার সাথে আবার কি কথা বলব?’ কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতি এবং পূর্বাপর বর্ণনা ধারা লক্ষ্য করলেই বুঝা যায় যে, মোজেযাকে এড়িয়ে চলার জন্যে এটা নিছক একটা অর্থহীন অপব্যাখ্যা মাত্র। এ অপব্যাখ্যাকারীরা আর কিছু না হোক শুধু কথাটাও ভেবৈ দেখলে পারতো যে, লোকরা যে ব্যাপারটা নিয়ে আপত্তি জানাতে এসেছিল সেটা তার যৌবনকালে ঘটেনি, ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময়েই ঘটেছিল। তাছাড়া সূরা আলে ইমরানের ৪৬তম আয়াতে এবং সূরা মায়েদার ১০ম আয়াতে দ্ব্যর্থহীনভাবে ও অকাট্যভাবে বলা হয়েছে যে, এসব কথাবার্তা হযরত ঈসা যৌবনকালে বলেননি, বরং তিনি যখন সদ্য প্রসূত এবং দোলনায় শায়িত তখনই বলেছেন। প্রথম আয়াতটিতে ফেরেশতা হযরত মরিয়মকে ছেলে হওয়ার পূর্বাভাস দেয়অর সময় বলেন যে, সে ছেলে মানুষের সাথে দোলনায় থাকতেও কথা বলবে, যৌবনকালেও কথা বলবে। দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ স্বয়ং হযরত ঈসা কে বলেন, তুমি দোলনায় থাকতেও মানুষের সাথে কথা বলবে, আর যৌবনকালেও বলবে।
“শিশু বলে উঠল, আমি আল্লাহর বান্দাহ। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন, নবী বানিয়েছেন এবং কল্যাণময় বানিয়েছেন -তা আমি যেখানেই থাকি না কেন, আর আমাকে আজীবন নামায ও যাকাত পালন করার নির্দেশ দিয়েছেন। আমাকে তিনি মায়ের হক আদায়কারী বানিয়েছেন, অত্যাচারী ও হতভাগ্য বানাননি”।-(সূরা মরিয়মঃ ৩০-৩২)
এখানে পিতা-মাতার হক আদায়কারী বলা হয়নি, শুধু মায়ের হক আদায়কারী বলা হয়েছে। এর থেকেও প্রমাণিত হয় যে, হযরত ঈসার বাপ ছিল না। কুরআনের সর্বত্র তাঁকে মরিয়মের ছেলে ঈসা বলে উল্লেখ করাও এর আর একটি অকাট্য প্রমাণ।
“আমি যেদিন জন্মেছি, যেদিন মরবো এবং যেদিন আবার জীবিত হব, সবসময়েই আমার ও পর শান্তি”।-(সূরা মরিয়মঃ ৩৩)
এ হল সেই ‘নিদর্শন’ যা হযরত ঈসা (আ)-এর সত্তার মাধ্যমে বনী ইসরাঈলের সামনে পেশ করা হয়েছিল। আল্লাহ বনী ইসরাঈলকে তাদের অবিরাম দুষ্কর্মের জন্যে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার আগে তাদের সংশোধনের সর্বশেষ সুযোগ দিতে চাচ্ছিলেন। সে জন্যে তিনি এ কৌশল অবলম্বন করলেন যে, বনী হারুনের যে ধার্মিকা মেয়েটি বায়তুল মাকদাসে ই’তেকাফরত ছিল এবং হযরত যাকারিয়ার তত্ত্বাবধানে লালিত পালিত হচ্ছিল তাকে হঠাৎ কুমারী অবস্থায় গর্ভবতী করে দিলেন। তারপর সে যখন বাচ্চা কোলে নিয়ে হাযির হবে তখন গোটা জাতির মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হবে এবং তাৎক্ষণিকভাবে সবার দৃষ্টি তার ওপরে পড়বে। এ কৌশলের ফলে হযরত মরিয়মকে ঘিরে মানুষের ভিড় জমে উঠল তখন তিনি সেই সদ্যপ্রসূত শিশুকে দিয়ে কথা বলালেন -যাতে করে সেই শিশু বড় হয়ে যখন নবুয়াত লাভ করবে তখন যেন জাতির হাজার হাজার লোক এ সাক্ষ্য দেয়ার জন্যে বিদ্যমান থাকে যে, তারা ঐ শিশুর মধ্যে আল্লাহ তায়ালার এক বিস্ময়কর মোজেযা দেখতে পেয়েছে। এতদসত্ত্বেও যখন জাতি তার নবুয়াত অস্বীকার করবে এবং তাকে অনুসরণের পরিবর্তে অপরাধী সাজিয়ে শূলে চড়ানোর চেষ্টা করবে, তখন তাদেরকে এক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হবে যা দুনিয়ার অন্য জাতিকে দেয়া হয়নি।
কুরআনের উল্লিখিত অন্যান্য মোজেযা
“আর যখন সে রাসূল হিসেবে বনী ইসরাঈলের কাছে এল, তখন বলল, আমি তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে তোমাদের কাছে নিদর্শন নিয়ে এসেছি। আমি তোমাদের সামনে মাটি দিয়ে পাখির প্রতিকৃতি বানাই। অতপর তাতে আমি ফুঁক দিতেই আল্লাহর ইচ্ছায় পাখী হয়ে যায়। আমি আল্লাহর ইচ্ছায় জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ রোগীকে আরোগ্য করি এবং মৃতকে জীবতি করি। তোমরা কি খাও আর কি সঞ্চিত করে রাখ তাও আমি বলতে পারি। তোমরা যদি ঈমান আনতে চাও তাহলে এসবের মধ্যে তোমাদের জন্যে যথেষ্ট নিদর্শন রয়েছে”।-(সূরা আলে ইমরানঃ ৪৯)
নবী মুহাম্মদ (সা) ও তাঁর মোজেযাসমূহ
কুরআনকেই নবুয়াতের প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হয়েছে
“হে নবী! তুমি তাদের সামনে কোনো নিদর্শন (মোজেযা)পেশ না করলে তারা বলেঃ তুমি নিজের জন্যে একটা নিদর্শন বেছে নিলে না কেন? তুমি তাদেরকে বলঃ আমি তো শুধু সেই অহীর অনুসরণ করি যা আমার রব আমার কাছে পাঠান। এ হলো তোমাদের রবের পক্ষ থেকে প্রজ্ঞার আলো, হেদায়াত ও রহমত তাদের জন্যে যারা একে গ্রহণ করে”।-(সূরা আল আরাফঃ ২০৩)
কাফেরদের এ প্রশ্ন ছিল স্পটত বিদ্রূপাত্মক। অর্থাৎ তাদের কথার অর্থ ছিল এইঃ ‘তুমি বাপু যেমন নবী হয়ে পড়েছ তেমনি নিজের জন্যে কখনো মোজেযাও বাছাই করে নিয়ে এলে পারতে’। কিন্তু এ বিদ্রূপের কেমন মনোজ্ঞ জবাব দেয়া হয়েছে, তা লক্ষণীয়।
এ জবাবের মর্ম হলোঃ তোমরা দাবী করলেই বা আমি নিজে প্রয়োজন বোধ করলেই একটা কিছু আবিস্কার করে অথবা বানিয়ে দেব এমন ক্ষমতা আমার নেই। আমি একজন রসূল মাত্র। আমার দায়িত্ব শুধু এই যে, যিনি আমাকে পাঠিয়েছেন তাঁর নির্দেশ মত কাজ করব। আমাকে যিনি পাঠিয়েছেন তিনি আমাকে মোজেযার পরিবর্তে কুরআন দিয়েছেন। এ দূরদৃষ্টিকারী আলোকে পরিপূর্ণ। এর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য এই যে, একে যারা মেনে নেয় তারা জীবনের সঠিক সরল পথের সন্ধান পায় এবং তাদের সুন্দর চরিত্রে আল্লাহর রহমদের চিহ্ন পরিস্ফুট হয়।
নবী মুহাম্মদ (সা) আপন উদ্যোগে মোজেযা দেখাতে সক্ষম ছিলেন না
“তথাপি (হে নবী) যদি তাদের উপেক্ষা তুমি সহ্য করতে না পার তাহলে ক্ষমতা থাকরে মাটির তলায় কোন সূড়ঙ্গ খুঁজে বের কর অথবা আকাশে একটা সিঁড়ি লাগাও এবং তাদের জন্যে একটা নিদর্শন নিয়ে আসার চেষ্টা কর”।-(সূরা আল আনআমঃ ৩৫)
নবী (সা) যখন দেখলেন যে, জাতিকে বুঝাতে বুঝাতে দীর্ঘ দিন কেটে গেল, তবু তারা পথে এলো না, তখন সময় সশয় তার মনে এ আকাক্সখা জাগতঃ “আহা যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন কোনো নিদর্শন প্রকাশ পেত যার দ্বারা তাদের কুফরী ঘুচে যেতো এবং তারা আমার নবুয়াতের সত্যতা মেনে নিত”। এ আয়াতে নবীর এ আকাক্সখারই জবাব দেয়া হয়েছে। তার মর্ম এইঃ অধৈর্য হয়ো না। যে নিয়মে এবং যে ধারা প্রক্রিয়ায় আমি এ কাজ চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, ধৈর্য্যের সাথে তার অনুসরণ কর। মোজেযা দিয়েই যদি কাজ নিতে হতো তাহলে তা কি আমি নিজে নিতে পারতাম না? কিন্তু আমি জানি যে, মানসিক ও নৈতিক বিপ্লব এবং যে নিষ্কলুষ তামাদ্দুনিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্যে তোমাকে নিয়োজিত করা হয়েছে সফলতার দ্বার প্রান্তে পৌঁছাবার সঠিক পথ এটা নয়। তথাপি মানুষের বর্তমান স্থবিরতা এবং তাদের কঠোর অস্বীকার-অবিশ্বাস যদি তোমার সহ্য না হয়, আর তুমি যদি মনে কর যে, এ স্থবিরতা দূর করার জন্যে কোনো স্থূল ও ইন্দ্রিয় গাহ্য নিদর্শন দেখানেই দরকার তাহলে নিজেই উদ্যোগ নাও এবং ক্ষমতা থাকলে যমীনের মধ্যে প্রবেশ করে অথবা আকাশে উঠে এমন কোনো মোজেযা নিয়ে আসার চেষ্টা কর যা অবিশ্বাসকে বিশ্বাসে পরিণত করার জন্যে তুমি যথেষ্ট মনে কর। তবে তুমি এ আশা কর না যে, আমি তোমার এ আকাক্সখা পূরণ করব। কেননা আমার পরিকল্পনায় এ ধরনের কোনো চেষ্টা-তদবিরের স্থান নেই।

নবী মুহাম্মদ (সা)-এর সবচেয়ে বড় মোজেযা কুরআন

“তারা বলে যে, মুহাম্মদ তাঁর প্রতিপারকের কাছ থেকে একটু নিদর্শন (মোজেযা) নিয়ে আসে না কেন? তাদের কাছে কি পূর্বতন গ্রন্থসমূহের সকল শিক্ষা সুস্পষ্ট হয়ে আসেনি”।-(সূরা ত্বাহাঃ ১৩৩)

অর্থাৎ এটা কি একটা ছোট-খাট মোজেযা যে, তাদেরই একজন নিরক্ষর লোক এমন একখানা কিতাব পেশ করেছেন যাতে প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত সমস্ত আসমানী কিতাবের বিষয়বস্তু ও শিক্ষার নির্যাস সন্নিবেশিত রয়েছে? মানুষকে সৎপথে চালিত করার জন্যে ওসব কিতাবে যা কিছু ছিল তা যে এ কিতাবে শুধু সন্নিবেশিত হয়েছে, তা-ই নয়, বরং তা এত সহজ ও স্পষ্ট ভাষায় বিবৃত হয়েছে যে, একজন মরুচারী বেদুঈনও তা বুঝতে পারে ও তা দ্বারা উপকৃত হতে পারে।

“(হে নবী!) তুমি ইতিপূর্বে না কোনো বই পড়তে আর না আপন হাত দিয়ে লিখতে পড়তে লিখতে পাররে বাতিলপন্থী লোক সন্দেহে পড়তো। আসলে যাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছে তাদের মনে এ উজ্জ্বল নিদর্শনগুলো রয়েছে। যালেমরা ছাড়া আর কেউ আমার নিদর্শন অবিশ্বাস করে না। তারা বলেঃ এ লোকটার ওপর তার প্রভুর পক্ষ থেকে নিদর্শনসমূহ (মোজেযা) অবতীর্ণ করা হয়নি কেন? তুমি বল! নিদর্শনসমূহ আল্লাহর কাছেই রয়েছে। আমি শুধু পরিস্কার ভাসায় সাবধানকারী। তাদের জন্যে এ নিদর্শন কি যথেষ্ট নয় যে, আমি তোমার ওপর কিতাব নাযিল করেছি যা পড়ে পড়ে তাদেরকে শোনানো হচ্ছে? বস্তুত আসলে এতে রয়েছে করুণা ও উপদেশ তাদের জন্যে যারা ঈমান আনে”।-(সূরা আল আনকাবুতঃ ৪৮-৫১)

এ আয়াতগুলোতে যে যুক্তির অবতারণা করা হয়েচে তার মূল কথা এই যে, হযরত মুহাম্মদ (সা) ছিলেন নিরক্ষর। তাঁর প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন ও গোত্রীয় লোকজন তাঁকে জন্ম থেকে যৌবন পর্যণ্ত দেখেছে এবং তারা এ কথা ভাল করেই জানত যে, তিনি সারা জীবনে না কোনো বই পড়েছেন আর না কখনো কলম হাতে নিয়েছেন। এ বাস্তব অবস্থার উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন, এ নিরক্ষর মানুষটির মুখ দিয়ে পূর্বতন আসমানী গ্রন্থসমূহের শিক্ষা, পূর্বতন নবীদের জীবন বৃত্তান্ত, সাবেক ধর্মসমূহের আকীদা ও বিশ্বাস, আদিম জাতিসমূহের ইতিহাস, সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি ও চারিত্রিক নীতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহের ওপর যে ব্যাপক ও গভীর তত্ত্বজ্ঞানের অভিব্যক্তি ঘটচে তা তিনি অহী ছাড়া আর কোনো পুস্তক পড়তে ও জ্ঞান-গবেষণা করতে দেখতো তাহলে হয়তো অবিশ্বাসীদের সন্দেহের কিছুটা অবকাশ থাকত। তাঁরা ভাবতে পারতো যে, তাঁর এ জ্ঞানসম্ভার অহীর পরিবর্তে নিজস্ব চেষ্টা-সাধনা দ্বারা অর্জিত হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু তাঁর নিরক্ষরতা লেশমাত্র সন্দেহের অবকাশ রাখেনি। এরপর নিরেট হঠকারিতা ছাড়া নবুয়াতের অস্বীকার করার পেছনে আর কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।

উম্মী হওয়া সত্ত্বেও কুরআনের মত গ্রন্থ নবী মুহাম্মদ (সা)-এর ওপর নাযিল হওয়াটাই এত বড় মোজেযা যে, তাঁর রসূল হওয়ার ওপর বিশ্বাসস্থাপন করার জন্যে তা যথেষ্ট। এরপর আর কোনো মোজেযা যারা তা দেখেছিল। কিন্তু কুরআন এমন কালজয়ী ও চিরন্তন মোজেযা, যা সবসময় মানুষের সামনে রয়েছে, তাদের কাছে পড়ে শুনানো হয় এবং সবসময় তারা তা দেখতেও পারে।

নবী মুহাম্মদ (সা)-কে বস্তুগত মোজেযার পরিবর্তে জ্ঞানগত মোজেযা দেয়ার কারণ

“এমন কোনো কুরআন যদি নাযিল করা হতো যার জোরে পাহাড় চলতে আরম্ভ করে দিন, পৃথিবী বিদীর্ণ হয়ে যেত অথবা মৃত ব্যক্তি কবর থেকে বেরিয়ে কথা বলা শুরু করে দিত, তাহলেই বা কি লাভ হত?”-(সূরা আর রা’আদঃ ৩১)

এ আয়াত বুঝবার জন্যে এ কথা মনে রাখতে হবে যে, এতে কাফেরদের সাথে নয় মুসলমানদের সাতে কথা বলা হয়েছে। মুসলমানরা কাফেরদের পক্ষ থেকে বারংবার মোজেযার দাবী শুনে অস্থির হয়ে উঠতেন এবং মনে মনে বলতেন, ওদের বিশ্বাস জন্মানোর মতো কিছু মোজেযা দেখিয়ে দেয়া হলে কতই না ভাল হতো। এ ধরনের কোনো নিদর্শন না আসার কারণে কাফেরগণ সাধারণ মানুষের মনে নবীর নবুয়াত সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়ানোর সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে এটা যখন তাঁরা অনুভব করতেন তখন তাঁদের অস্থিরতা ও উদ্বেগ আরো বেড়ে যেত। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মুসলমানদের বলা হচ্ছে যে, কুরআনের কোনো সূরার সাথে সাথে হঠাৎ করে এ জাতীয় কোনো নিদর্শনও যদি দেখান হতো, তাহরে কি সত্যিই তারা ঈমান আনত বলে তোমরা মনে কর? তোমরা কি তাদের সম্পর্কে এতই আশাবাদী যে, তারা সত্যদ্বীন গ্রহণ করার জন্যে একেবারে প্রস্তুত হয়ে বসে আছে শুধু একটা প্রকাশই বাকী রয়েছেঃ কুরআনের শিক্ষায় বিশ্ব প্রকৃতির নিদর্শনাবলীতে নবীর নিষ্কলুষ জীবনে এবং সাহাবায়ে কেরামের জীবনের বিপ্লবী পরিবর্তনে যারা সত্যের আলোর দর্শন পেল না, তোমরা কি ভেবেছ যে তারা পাহাড় চালিত হওয়া, পৃথিবী বিদীর্ণ হওয়া এবং মৃত ব্যক্তিদের কবর থেকে বেরিয়ে আসার মধ্যে কোনো আলোকরশ্মির সন্ধান পাবে।-[এ আলোচনার অর্থ এ নয় যে, নবী মুহাম্মদ (সা)-এর পক্ষ থেকে কোনো মোজেযা প্রকাশ পায়নি। সময়ে সময়ে অনেক মোজেযাই প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু এগুলো বিরোধীদের ঈমান আনার জন্যে নবুয়াতের প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়নি।-(সংকলকবৃন্দ)]

“আমি ইচ্ছা করলে আসমান থেকে এমন নিদর্শন নামিয়ে দিতে পারি যার সামনে তাদের মাথা নুয়ে পড়বে”।-(সূরা শুয়ারাঃ ৪)

অর্থাৎ সকল কাফেরকে ঈমান আনতে ও আল্লাহর আনুগত্য মেনে নিতে বাধ্য করে এমন কোনো নিদর্শন নাযিল করে দেয়া আল্লাহর পক্ষে মোটেই কঠিন কাজ নয়। তিনি যে এমন করছেন না তার কারণ এ নয় যে, এ কাজ তাঁর ক্ষমতার বহির্ভূত। আসলে লোকদের এ ধরনের বাধ্যতামূলক ঈমান তাঁর বাঞ্ছিত নয়। তিনি চান লোকেরা নিজ নিজ জ্ঞান-বুদ্ধি খাটিয়ে আল্লাহর কিতাবে, বিশ্বপ্রকৃতির সর্বত্র এবং স্বয়ং তাদের মধ্যে যেসব নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে তার সাহায্যে সত্যকে উপলব্ধি করুক। তারপর যখন তাদের মন সাক্ষ্য দেবে যে, নবীগণ যা বলেছেন আসলে সেটাই সত্য আর তার বিপরীত যতসব আকীদা-বিশ্বাস ও রীতি-পদ্ধতি চালু রয়েছে তা সবই বাতিল ও অসত্য, তখণ তারা জেনে-বুঝে বাতিলকে ত্যাগ করে সত্যকে অনুসরণ করাই এমন কাজ যা আল্লাহ তায়ালা মানুষের কাছে দাবী করেন। এ কারণেই তিনি মানুষকে ইচ্ছা ও এখতিয়ারের স্বাধীনতা দান করেছেন। এ কারণেই তিনি মানুষকে এ স্বাধীনতা দিয়েছেন যে, সে ইচ্ছা করলে সঠিক অথবা ভ্রান্ত যে কোনো একটা পথ গ্রহণ করতে পারে। এ কারণেই তিনি মানুষের মধ্যে ভাল ও মন্দ এ উভয় প্রবণতাই দান করেছেন। পাপ ও পুণ্য উভয়ের পথই তার সামনে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। শয়তানকে ধোঁকা দেয়ার স্বাধীনতা দিয়েছেন। সঠিক পথ-প্রদর্শনের জন্যে নবুয়াত, অহী এবং মঙ্গলের দিকে দাওয়াতের ধারাবাহিকতা কায়েম করেছেন। মানুষকে মত ও পথ বেছে নেয়ার যাবতীয় সময়োপযোগী যোগ্যতা ও ক্ষমতা দিয়ে পরীক্ষা ক্ষেত্রে দাঁড় করিয়েছেন এটা দেখার জন্যে যে, সে কুফরী ও অবাধ্যতার পথ অবলম্বন করে, না ঈমান ও আনুগত্যের পথ। মানুষকে ঈমান ও আনুগত্যে বাধ্য করে এমন কোনো ব্যবস্থা যদি আল্লাহ গ্রহণ করতেন তাহলে এ পরীক্ষার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যেত। ঈমান আনতে মানুষকে বাধ্য করাই যদি তাঁর ইচ্ছা হত তাহলে মোজেযা দেখিয়ে বাধ্য করার কি দরকার ছিল? আল্লাহ মানুষকে এমন স্বভাব-প্রকৃতি ও এমন গঠন দিয়ে সৃষ্টি করতে পারতেন যে, কুফরী, নাফরমানী ও পাপাচারের কোনো ক্ষমতাই তার থাকত না। ফেরেমতাদের মত মানুষও ফরমাবরদার ও অনুগত হয়েই জন্ম নিত। কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ তায়ালা এ সত্যটাই তুলে ধরেছেন। যেমনঃ

“তোমাদের প্রভু যদি চাইতেন তাহলে দুনিয়ার সমস্ত অধিবাসী মুমিন হয়ে যেত। তুমি কি এখন মানুষকে ঈমান আনতে বাধ্য করতে চাও?”-(সূরা ইউনুসঃ ৯৯)

“তোমার প্রভু যদি চাইতেন তাহলে সকল মানুষকেই একই উম্মতভুক্ত করে দিতে পারতেন। তারা তো বিভিন্ন পথেই চলতে থাকবে। (বিভ্রান্তি থেকে) বেঁচে যাবে শুধু তাঁরাই যাদের ওপর তোমার প্রভুর অনুগ্রহ রয়েছে। তাদেরকে তিনি এ উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি করেছেন”।

“তারা কি কখনও পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে দেখেনি যে, কত বেশী পরিমাণে সব রকমের উৎকৃষ্ট উদ্ভিদ সেখানে পয়দা করেছি?”-(সূরা আশ শুয়ারাঃ ৭-৮)

অর্থাৎ সত্যকে খুঁজে পেতে কারো যদি নিদর্শনের প্রয়োজন হয়, তাহলে তাকে বেশী দূরে যেতে হবে না। এ দুনিয়ার রূপ-বৈচিত্র্যকে একটু চোখ মেলে দেখে নিলেই সে বুঝতে পারবে বিশ্ব-প্রকৃতির ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে যে তত্ত্ব (আল্লাহর একত্ব) নবীগণ পেশ করেছেন সেটাই সত্য, না সত্য সেসব মতবাদ যা মুশরিক ও নাস্তিকরা প্রচার করছে। পৃথিবীতে উৎপন্ন উদ্ভিদরাজির এত অধিক ও বিচিত্র সমাবেশ, এগুলোর গুণাগুণে ও অসংখ্য সৃষ্টির অসংখ্য চাহিদায় যে সুস্পষ্ট মিল ও সামঞ্জস্য বিদ্যমান তা দেখে একজন নির্বোধই এ সিদ্ধান্ত নিতে পারে যে, কোনো নিপুণ কুশলীর তীক্ষè কর্মকুশলতা, কোনো মহাজ্ঞানীর প্রজ্ঞা, কোনো মহাশক্তিদরের অজেয় শক্তি এবং কোনো দক্ষ স্রষ্টার সুচিন্তিত সৃষ্টি পরিকল্পনা ছাড়াই এসব আপনা আপনিই হচ্ছে। অথবা এ সমস্ত পরিকল্পনা রচনা ও বাস্তবায়নকারী কোনো এক খোদা নয় বরং বহুসংখ্যক খোদার ব্যবস্থাপনায় পৃথিবী, চন্দ্র, সূর্য, বাতাস ও পানির মধ্যে এমন সুষ্ঠু সমন্বয় স্থাপিত হতে পেরেছে এবং এসব উপকরণে তৈরী উদ্ভিদরাজি ও সীমা সংখ্যাহীন রকমারি জীব-জানোয়ারের চাহিদা ও প্রয়োজনের মধ্যে এমন সামঞ্জস্য গড়ে তুলেছে। একজন বিবেকবান মানুষ হঠকারিতা ও আগে থেকে কোনো বদ্ধমূল ধারণায় যদি লিপ্ত না হয়, তাহলে এ দৃশ্য অবলম্বন করে স্বতঃস্ফুর্তভাবে বলে উঠবে যে, এগুলো নিশ্চয়ই খোদার অস্তিত্ব এবং একই খোদার অস্তিত্বের অকাট্য প্রমাণ। এসব প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও আর কোনো মোজেযার প্রয়োজন থাকতে পারে কি, যা না দেখলে তাওহীদের সত্যতার প্রতি মানুষ বিশ্বাসী হতে পারে না?


শেয়ার করুন