ডেস্ক রিপোর্ট :
সংসারের সমস্ত কাজ সামলেই ‘সূঁচ-সুতা দিয়ে আঁকা’ চিত্রশিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশে সক্ষম হয়েছেন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের প্রতিবেশী ৪৪ বছর বয়সী ইলোরা পারভীন। বর্তমানে সরকারি চাকরিজীবী স্বামী ও দুই সন্তানসহ যার বসবাস আজিমপুর সরকারি কোয়ার্টারে।
বাল্য বয়সে তিনি এসএম সুলতানের বাড়িতে চুপি দিতেন। দেখতেন রোদে বসে এসএম সুলতান কীভাবে ছবি আঁকেন। এখান থেকেই তিনি অনুপ্রেরণা লাভ করেন। তিনি বলেন- রঙে আঁকা ছবির মধ্যে গলা-হাত-নাক-কানসহ বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ভাঁজ, পরনের কাপড়ের ভাঁজই আমাকে আকর্ষণ করত। উঁচু-নিচু অংশ কীভাবে ফুটিয়ে তুলে, সেটি আমার মধ্যে ভীষণ কৌতূহল সৃষ্টি করেছিল।
রঙ-তুলি না হয়ে সুঁচ-সুতা কেনÑ উত্তরে জানা যায়, বাল্যবয়স থেকেই তার সূঁচ-সুতার সঙ্গে ঘর-সংসার শুরু হয়। সেসময় তিনি শাড়ি, বিছানার চাদরসহ নানা রকমের পোশাকে সূঁচ-সুতার কাজ করতেন।
চিত্রশিল্পে পদার্পণ হিসেবে তিনি জানান, ১৯৯৮ সালে ইডেন মহিলা কলেজ থেকে দর্শনে মাস্টার্স পাসের পর নিজ গ্রামের বাড়ি নড়াইলের মাসিমদিয়ায় ফেরেন ইলোরা। এরই মধ্যে এসএম সুলতানের মৃত্যুর হয়। এসময় ইলোরা এসএম সুলতানের শিষ্য দুলাল চন্দ্র ঘোষের কাছ থেকে হাতেখড়ি নেন। দুলালের কাছে ইলোরা সূঁচ-সুতায় ছবি আঁকবেন জানালেÑ এটি পারা কঠিন কিন্তু সম্ভব বলে উত্তর দেন দুলাল। এমনকি দুলাল ইলোরাকে প্রচুর উৎসাহ দিতে থাকেন।
ইলোরা বলেন, দুলাল দার কথা শুনলে মনে হতো হেঁটে মঙ্গল গ্রহে চলে যেতে পারব। ২ বছর আগে দুলালের মৃত্যু হয়Ñ কথাটি বলতে গিয়েই তার চোখ ভিজে আসে।
বলতে থাকেনÑ আগে ছবি এঁকে তাকে দেখাতাম, ভুলত্রুটি শুধরে নিতাম। এখন এমন কাউকে পাই না।
একটি বইয়ের কভারে থাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি আঁকার মাধ্যমেই ইলোরা এ পথে হাঁটতে শুরু করেন ১৯৯৮ সালে। এই ছবি দেখে দুলাল নাকি খুব অবাক হয়েছিলেন এবং আরো অনুপ্রেরণা যোগাতে থাকেন। ১৯৯৯ সালে ইলোরা সংসারি হন মো. ফয়জুল্যাহ বিশ্বাসের সঙ্গে। দু’সন্তানের জননীও হন। কিন্তু সূঁচ-সুতার সঙ্গে সম্পর্ক এতটুকু ছেদ পড়তে দেননি তিনি। স্বামীর সহযোগিতাও কম পাননি। মো. ফয়জুল্যাহ বিশ্বাস বলেন, ও কীভাবে সংসারের সব কাজ সেরে এসব করে, মাঝে মধ্যে ভেবে অবাকই হই। কখনই তাকে এসব কাজে বাধা দিইনি। সর্বাত্মক সহযোগিতাই করে এসেছি।
সেই ১৯৯৮ সাল থেকে ২০১৬ সালের এ পর্যন্ত তিনি মোট ১৮টি শিল্পকর্ম শেষ করতে সক্ষম হয়েছেন। প্রতিটিতে শেষ করার তারিখ লিখা রয়েছে সূঁচ-সুতা দিয়েই। তার চিত্রশিল্পে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবার। এর সংখ্যা ছয়। এসবের মধ্যে দাঁড়ানো অবস্থায় বঙ্গবন্ধু তার কন্যা শেখ হাসিনাকে ¯েœহের, একক বঙ্গবন্ধুর তিনটি, একক শেখ ফজিলাতুন্নেসার একটি, একক শেখ হাসিনার একটি, শেখ হাসিনার পাঁচ ভাইবোনের গ্রুপ ছবি একটি। এসবের একটি যশোরে নিজ বড়ভাই স্থানীয় চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা হাসানুজ্জামানের অফিসে একটি ফ্রেমে বাঁধাই করা, বাকিগুলো নিজ বাসায় ফ্রেমে সাজিয়ে রেখেছেন।
তিনি বলেন, আসলে বঙ্গবন্ধুর ছবি দিয়ে হাতেখড়ি, পরিবারিকভাবে তার দলের রাজনীতি সঙ্গে আমরা যুক্ত। অন্য বিষয়ে ছবি আঁকার চেষ্টা করেছি। একটা শেষ করার পর ভাবি, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আর আঁকবো না, কিন্তু আবার চলে যাই বঙ্গবন্ধুতেÑ হাসিমুখে বলে তিনি।
বঙ্গবন্ধু তার কন্যা শেখ হাসিনাকে ¯েœহের চিত্রকর্মটি ফ্রেমসহ দৈর্ঘ্য ৩০ ইঞ্চি প্রস্থ ২১ ইঞ্চি। বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা ও শেখ হাসিনার পাঁচ ভাই-বোনের ছবির আকৃতিও ৩০ ইঞ্চি প্রস্থ ২১ ইঞ্চি অথবা এর চেয়ে সামান্য কম-বেশি।
এছাড়াও একটি করে ভাষা আন্দোলন, রায়েরবাজারের বধ্যভূমি, জাতীয় সম্পদ, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, এসএম সুলতান, নববধূ, পাখি, নিজ মা নূরজাহান, নিজের ছবি এঁকে ফেলেছেন। ৫ ফুট দৈর্ঘ্যে ও ৩ ফুট প্রস্থের ভাষা আন্দোলনের ছবিটি আঁকতে সময় লেগেছে ২ বছর। ৪২/২০ ইঞ্চি আকৃতির বধ্যভূমির ছবি আঁকতে সময় লেগেছে চার মাস, পত্রিকায় ছাপা দেখে শেখ হাসিনার পাঁচ ভাই-বোনের ছবি আঁকতে সময় লেগেছে চার মাস।
ইলোরা বলেনÑ সময় বেশি লাগে গলা, হাত, পরনের কাপড়ের ভাঁজ তুলতে। কোনো কোনো ছবির ‘চোখ’ আঁকতেই ১৫-২০দিন লেগে যায়। সামান্য এদিক-ওদিক হলেই পুরো কাজ শেষ। আর একটু সময় এমনিতেও নিলে ভাল। মস্তিষ্কে চাপ কম পড়ে, চোখের ভাল হয়। কোনো কোনো কাজ করার পর এক নাগাড়ে ১৫দিন পর্যন্ত আমার মাথায় ব্যাথ্যা থাকতো। ‘ঘোড়ায় চড়ে রাজা পালকিতে বউ নিয়ে ফিরছেন’Ñ তুলি-রঙে আঁকা এমন একটি ছবিও তিনি এঁকে ফেলেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, দেখলাম রঙে আঁকা কেমন লাগে। আসলে রঙের ছবি প্রাণ কম মনে হলো।
ইলোরার ইচ্ছে শেখ হাসিনার পাঁচ ভাইবোনের গ্রুপ ছবিটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তুলে দেবেন নিজ হাতে, বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার কিছু ছবিও দেয়ার ইচ্ছে আছে তার। ইলোরার স্বামী শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে চাকরির সুবাদে এ ইচ্ছা পূরণ তার মাধ্যমে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু নিজ হাতে দেয়ার সুযোগ করে দিতে পারেন না কেউ-ই। তিনি বিশ্বাস করেনÑ এমন সুযোগ একদিন আসবেই।
হাবিবুর রহমান ও নূরজাহান বেগম দম্পত্তির সাত ভাইবোনের মধ্যে ইলোরা পঞ্চম। তার বড় মেয়ে হুমাইরা ফয়েজ ভিকারুন্নিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আজিমপুর শাখায় অধ্যয়নরত, দ্বিতীয় সন্তানের বয়স ৬ বছর। এ পর্যন্ত নিজ শিল্পকর্মগুলো কোথাও প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে পারেননি তিনি।