ইউপি ও পৌর নির্বাচনী সহিংসতায় ১ মাসে নিহত ১৪ জন

111112-400x225সিটিএন ডেস্ক:

প্রথম দফায় দেশের ৩৪ জেলার ৭৩৪টি ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার পর বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্ত সংঘষের্র ঘটনা ঘটছে। প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে। নির্বাচনের আগেই গত সোমবার পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকায় সহিংসতায় ১৪ জন নিহত হয়েছেন।
এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত সহস্রাধিক ব্যক্তি। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন জেলায় ইউপি নির্বাচনের প্রচারকে কেন্দ্র করে হামলা, ভাঙচুর ও সংঘর্ষের ঘটনা প্রতিদিনই ঘটেছে বলে সংশি¬ষ্ট চেয়ারম্যান ও মেম্বর প্রার্থীদের দেয়া অভিযোগ থেকে জানা গেছে। বেশিরভাগ সহিংসতায় সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে সরকার সমর্থক প্রার্থীদের। বিভিন্ন জেলায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ও তার সমর্থকরাই সংঘর্ষে জড়িয়ে সহিংসতা সৃষ্টি করেছে। আক্রান্ত হয়েছে সরকার সমর্থক বিদ্রোহী ও বিএনপির প্রার্থীরা।
এ ছাড়া বিভিন্ন স্থানে প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের নির্বাচনী প্রচারণায় বাধা দেয়ায়ও সংঘর্ষ সহিংসতা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে-সহিসংতা বন্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সংশ্লিষ্টদের ধারণা নির্বাচনের পরে এ সহিংসতা আরো বেড়ে যেতে পারে। ইসির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথমবার দলীয়ভিত্তিতে নির্বাচন হওয়ার কারণে এবার সহিংসতা যেন অন্যবারের চেয়ে বেশি হচ্ছে। তবে সহিসংতা ঠেকাতে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। পুলিশের বিরুদ্ধে সরকার সমর্থকদের পক্ষাবলম্বনের অসংখ্য অভিযোগ এসেছে ইসিতে। এছাড়াও স্থানীয় প্রশাসন, বিশেষ করে রিটার্নিং অফিসারের কাছে অভিযোগ করেও প্রতিকার পাচ্ছেন না প্রার্থীরা। এছাড়াও মুন্সিগঞ্জ, কুমিল্লা, সাতক্ষীরা, বগুড়া, যশোর, খুলনা, বাগেরহাট, ময়মনসিংহ, জামালপুর, পাবনাসহ বিভিন্ন এলাকায় সহিংসতায় অনেক লোক আহত হয়েছে।
মেম্বার প্রার্থীর হাতের কব্জি কেটে উল্লাস : ভোলার লালমোহনে মেম্বার প্রার্থীর হাতের কব্জি কেটে উল্লাস করার মতো লোমহর্ষক ঘটনা ঘটেছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, রোববার সকাল ৮ টার দিকে জাকির হোসেন ভূঁইয়া ধলিগৌরনগর ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ড চর মোল্লাজী গ্রামে নির্বাচনী প্রচার করতে যায়। এসময় পূর্ব থেকে ওঁৎপেতে থাকা প্রতিপক্ষ গিয়াস ভূঁইয়ার ক্যাডার রিয়াজের নেতৃত্বে কিছু লোক জাকিরের উপর হামলা চালায়। এক পর্যায়ে ক্যাডাররা জাকিরের বাম হাতের কব্জি কেটে তাকে পার্শ্ববর্তী খালে ফেলে দিয়ে উল্লাস করতে থাকে।
খবর পেয়ে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে লালমোহন উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সে ভর্তি করে। সেখানে তার অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাকে দুপুর পৌনে ১টায় লালমোহন থেকে হেলিকপ্টারযোগে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়।
২২ মার্চ অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে নোয়াখালীতে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে আহত দুইজনের মধ্যে মো. ওয়াসিম (২৪) মারা গেছেন। তিনি নোয়াখালী জেলা ছাত্রলীগের সদস্য। আজ মঙ্গলবার ভোরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান তিনি।
এর আগে সোমবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে নোয়াখালী পুরাতন কলেজসংলগ্ন অনস্তপুর গ্রামে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে নিজ দলের কর্মীদের হাতে গুলিতে নিহত হন নোয়াখালী কলেজ ছাত্রলীগের কর্মী রাজিব (২২)। ওই ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হন জেলা ছাত্রলীগের সদস্য ওয়াসিম ( ২৪) ও ছাত্রলীগ কর্মী ইয়াছিন (২০)।
আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাদেরকে প্রথমে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতাল ও পরে কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে তাদের অবস্থার অবনতি হলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে আজ সোমবার ভোর চারটার দিকে মারা যান ওয়াসিম।
২২ মার্চ বরিশালের বানাড়িপাড়া উপজেলার বিষরকান্দি ইউনিয়নে দায়িত্ব পালনকালে অসাবধানতাবশত রাইফেলের গুলিতে আল-আমিন (৪০) নামে এক আনসার সদস্য নিহত হয়েছেন। মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে বিষরকান্দি ইউনিয়নের মুরাররাড়ি ভোটকেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বানাড়িপাড়া থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জিয়াউল ইসলাম।
২১ মার্চ জেলার মহেশখালী পৌরসভা নির্বাচনে ভোট গ্রহণ শেষে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ আবদুর শুক্কুর (২০) মারা গেছেন। গতকাল সোমবার দুপুর ১টার দিকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
২০ মার্চ রোববার দিবাগত রাতে বান্দরবানের রুমা উপজেলার গালেঙ্গা ইউনিয়নের সম্ভাব্য চেয়ারম্যান প্রার্থী শান্তি প্রিয় ত্রিপুরাকে (৩৮) বাসা থেকে ডেকে নিয়ে খুন করেছে দুর্বৃত্তরা। রাত সাড়ে ৩টার সময় তাকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। এলাকাবাসীরা জানান, রাতে এক দল অস্ত্রধারী রামদোপাড়া এলাকায় এসে এবারের তৃতীয় ধাপের ইউপি চেয়ারম্যান প্রার্থী শান্তি প্রিয় ত্রিপুরাকে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে রামদোপাড়া এবং মঘাপাড়া এলাকার মাঝামাঝি এলাকায় গুলী করে হত্যা করে চলে যায়।

১৯ মার্চ পাবনার বেড়া উপজেলার ঢালারচর ইউনিয়নে অওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী ও আ’লীগ বিদ্রোহী প্রার্থীর মধ্যে নির্বাচনি আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। এতে গুলীবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছে একজন ও আহত হয়েছে ৭ জন। নিহত ব্যক্তির নাম গহের মন্ডল (৩০)। তিনি ঢালারচর ইউনিয়নের খয়েরবাগান গ্রামের পাশান মন্ডলের ছেলে। রাত সাড়ে ১১টার দিকে ঢালারচর ইউনিয়নের মিরপুর গ্রামে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
১৬ মার্চ বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের ভাসানচরে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে ৫ নং ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি সমীর চারু নিহত হন। তার মা, বাবা ও ছোট ভাইসহ মোট ১০ জন গুরুতর আহত হন। ১৪ মার্চ রাতে নির্বাচনকেন্দ্রিক সংঘর্ষে বগুড়ার শিবগঞ্জের বুড়িগঞ্জ ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে মাহতাব আলী মারা যান।

১৪ মার্চ বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলায় আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মনোনীত প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে মাহাতাব হোসেন (৫০) নামে একজন নিহত হয়েছেন।
১৩ মার্চ রাত ১২টার দিকে কিশোরগঞ্জ জেলার মহিনন্দ ইউনিয়নের বেরুয়াইল গ্রামে নিজের বাড়ির কাছে সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন কৃষক মো. সোহেল মিয়া (৩২)। মহিনন্দ ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য পদপ্রার্থী আবদুস ছালামের সমর্থক ছিলেন সোহেল। ওইরাতে অপর সদস্য প্রার্থী মো. শফিকুল ইসলামের সমর্থকদের সঙ্গে তার বাকবিত-া হয়। এর জেরে সোহেলকে ছুরিকাঘাত করা হয়।

১১ মার্চ ভোলা সদরের চরসামাইয়া ইউনিয়নে নির্বাচনের প্রচার শেষে বাড়ি ফেরার পথে দুর্বৃত্তের হামলায় নিহত হয়েছেন সিরাজুল ইসলাম। সকালে চরসামাইয়া ইউনিয়নের বজলু মেম্বারের পক্ষে প্রচার শেষে বাড়ি ফিরছিলেন সিরাজসহ কয়েকজন।

শান্তিরহাট বেড়ীর পাড় এলাকায় দুর্বৃত্তরা সিরাজকে মারধর করে পালিয়ে যায়। স্থানীয়রা সিরাজকে উদ্ধার করে ভোলা সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন।

৮ মার্চ পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার আদাবাড়িয়া ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে নিহত হন আওয়ামী লীগ-মনোনীত চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী সামসুল হকের খালাতো ভাই আশরাফ ফকির (৩৫)।

৮ মার্চ রাতে পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সমর্থকদের হামলায় নিহত হন বিএনপির চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীর ভাগ্নে ছাত্রদল নেতা শামসুল হক (২৮)। শামসুল হক নাজিরপুর উপজেলা ছাত্রদলের যুগ্ম আহবায়ক ছিলেন।

২২ ফেব্রুয়ারি বরগুনার আমতলীতে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে বশির উদ্দিন (৩৫) নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়। নিহত বশির উদ্দিন আমতলীর হলদিয়া গ্রামের বাসিন্দা কাঞ্চন আলী সিকদারের ছেলে।

স্থানীয় থানার ওসি পুলক বলেন, তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাকির হোসেন ও বিদ্রোহী প্রার্থী শহিদুল ইসলামের সমর্থকদের সংঘর্ষ হয়। এতে পুলিশসহ ১৩ জন আহত হন। পরে আহত একজনের মৃত্যু হয়।
এদিকে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক রোববার গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, সারাদেশে ইউপি নির্বাচন পূর্ববর্তী মোট ২০৮টি সহিংসতারর ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় সেদিন পর্যন্ত সাতজনের প্রাণহানি ঘটেছে। রোববার পুলিশ হেড কোয়ার্টার্সে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি একথা বলেন। আইজিপি বলেন, ছোট বড় এসব সহিংসতার ঘটনায় ১৪৩ মামলা ৫৫টি সাধারণ ডায়েরী (জিডি) নিয়েছে পুলিশ। সরকারদলীয় প্রার্থীদের কোন ধরণের ছাড় দেয়া হচ্ছে না উল্লেখ করে আইজিপি বলেন, নির্বাচন পূর্ববর্তী সহিংসতার ঘটনায় এ পর্যন্ত ৯৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

পুলিশ সরকারদলীয় প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করছে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে আইজিপি বলেন, অভিযোগ আপনাদের কাছে আসলে হবে না। আমাদের কাছে অভিযোগ দেন। আমরা অ্যাকশন নেব।


শেয়ার করুন