আসছে বিএনপিতে ‘বড় পরিবর্তন’

03_273747-400x266সিটিএন ডেস্ক:
সব কিছু ঠিক থাকলে আগামী নভেম্বরের আগেই বিএনপির নির্বাহী কমিটিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে। সক্রিয় নেতাদের অন্তর্ভুক্ত করার পাশাপাশি বয়োবৃদ্ধ ও নিষ্ক্রিয় সদস্যদের বাদ দিয়ে পুনর্গঠন করা হবে দলের স্থায়ী কমিটি।
বিএনপির নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রের দাবি, কেন্দ্রীয় কমিটি পুনর্গঠনের লক্ষ্যে একটি খসড়া তালিকা তৈরি করার জন্য দলের স্থায়ী কমিটির সক্রিয় এক সদস্যকে দায়িত্ব দিয়ে গেছেন দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। লন্ডন যাওয়ার আগে তিনি এই দায়িত্ব দিয়ে যান। তবে দলের জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই পুনর্গঠন হবে কি না তা এখনো নিশ্চিত নয়। বিএনপির দায়িত্বশীল নেতাদের আশঙ্কা, কাউন্সিল করার উদ্যোগ নেওয়া হলেই সরকার নানাভাবে ‘ডিসটার্ব’ করতে পারে।
এদিকে দলের কাউন্সিল না হলেও বর্তমান ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে মহাসচিব করা হবে বলে মোটামুটি নিশ্চিত বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা। অন্যদিকে দলের সাংগঠনিক কর্তৃত্ব পুরোপুরি তারেক রহমানের হাতে চলে যেতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে। বিশেষ করে লন্ডনে এ ধরনের আলোচনাই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে। তবে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে থাকাবস্থায় কী করে দল সামলাবেন তা নিয়েও প্রশ্ন আছে দলের মধ্যে।
বিএনপিপ্রধান খালেদা জিয়া ও তাঁর ছেলে দলের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা তারেক রহমান উভয়েই এখন লন্ডনে রয়েছেন। দলীয় নেতাদের ধারণা, দল পুনর্গঠনসহ নানা বিষয়ে দুজনের মধ্যে আলোচনা হবে। আর এ ক্ষেত্রে তারেকের মতামতকে এবার খালেদা জিয়া বেশি মূল্য দেবেন।
এদিকে কেন্দ্রের নির্দেশনা অনুযায়ী আজ ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে তৃণমূল পর্যায়ে দল পুনর্গঠনের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে তা হচ্ছে না। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অনেক জেলা-উপজেলায় দলীয় সম্মেলন বা কমিটি পুনর্গঠনের সময় বাড়ানো হয়েছে এরই মধ্যে।
লন্ডনে যাওয়ার আগেই জেলা, উপজেলা ও পৌর বিএনপি পুনর্গঠনের কাজ শুরু করে যান খালেদা জিয়া। নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে, মূলত কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি পুনর্গঠনের পূর্ব-প্রস্তুতি হিসেবেই সারা দেশে তৃণমূল পর্যায়ে দলের কমিটি পুনর্গঠনের কাজ শুরু করা হয়। ওই কাজ ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে করার নির্দেশনা থাকলেও তা শেষ করতে অক্টোবর পার হবে। পরে পরিস্থিতি বুঝে জাতীয় কাউন্সিল করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কাউন্সিল না করতে পারলে জেলা কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের ঢাকায় ডেকে ছোট পরিসরে আলোচনা করে নির্বাহী কমিটি পুনর্গঠন করা হবে।
বিএনপির বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা জানান, দল পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে খালেদা জিয়া এবার বেশ কঠোর হবেন বলে তাঁদের ধারণা। দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা মনে করেন, এ বছর এবং গত বছর ৫ জানুয়ারি ঘিরে আন্দোলন ব্যর্থ হয় বিএনপির বিশেষ করে ঢাকা মহানগর বিএনপি নেতাদের নিষ্ক্রিয়তায়। সরকারের সঙ্গে ‘সদ্ভাব’ রেখে কারা ‘গা বাঁচিয়ে’ চলছেন সে খবরও খালেদা জিয়ার কাছে আছে। ফলে আন্দোলনে ভূমিকা পালনকারী নেতাদেরই এবার তিনি মূল্যায়ন করবেন। পুনর্গঠনের ব্যাপারে গত ৯ আগস্ট কেন্দ্রের পাঠানো চিঠিতেও এমন আভাস দেওয়া হয়েছে। তবে ওই চিঠির নির্দেশনা অনুযায়ী ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে দলের পুনর্গঠনকাজ শেষ হচ্ছে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দল পুনর্গঠনের বিষয়ে এবার খুবই সিরিয়াস। নিশ্চয়ই এ বিষয়ে তিনি সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলোচনা করবেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘চেয়ারপারসন কাকে রাখবেন বা বাদ দেবেন সেটি পুরোপুরি তাঁর এখতিয়ার। তবে অপেক্ষাকৃত তরুণদের অন্তর্ভুক্ত করা তৃণমূল বিএনপির এখন অন্যতম দাবি। এ ছাড়া দলের কর্মকা-ে কারা সক্রিয় কারা নিষ্ক্রিয় তাও চেয়ারপারসনের অজানা নয়।’
দলের স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘দল পুনর্গঠনের ব্যাপারে কোথায় কী অগ্রগতি হয়েছে সে বিষয়ে আমরা প্রতিবেদন সংগ্রহ করছি। দু-এক দিনের মধ্যেই হয়তো বোঝা যাবে কত দূর হলো। তবে সময় বাড়ানোর ব্যাপারে চেয়ারপারসনের সঙ্গে কথা বলতে হবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নির্বাহী কমিটি পরিবর্তন বা এ-সংক্রান্ত খসড়া তৈরি হচ্ছে কি না সে সম্পর্কে আমার কিছু জানা নেই।’
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, ‘দলে কারা সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় এবং আন্দোলন-সংগ্রামে কাদের অবদান রয়েছে এসব খবর বিভিন্ন জায়গা থেকে পাচ্ছেন চেয়ারপারসন। ফলে দল পুনর্গঠন করতে গেলে এগুলোর ভিত্তিতে তালিকা তৈরি করা স্বাভাবিক। তবে দলের গঠনতন্ত্রে উল্লিখিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কমিটি গঠনের বিষয়টির প্রতি সবার যতœবান হওয়া উচিত।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পরবর্তী জাতীয় কাউন্সিল পর্যন্ত দল পুনর্গঠন, সংশোধন বা যেকোনো পরিবর্তনের কর্তৃত্ব চেয়ারপারসনকে দেওয়া আছে। তিনি ইচ্ছা করলে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।’
দলের যুগ্ম মহাসচিব মোহম্মদ শাহজাহান বলেন, ‘দল পুনর্গঠন যখন শুরু হয়েছে তখন নিশ্চয়ই এ প্রক্রিয়া এক জায়গায় থামবে না। তবে কাউন্সিল কবে হবে বা আদৌ হবে কি না তা পরিস্থিতি বলে দেবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কেন্দ্রের চিঠি যাওয়ার পর এরই মধ্যে প্রায় দুই শ উপজেলায় বিএনপির সম্মেলন হয়েছে। অক্টোবরের মধ্যে আরো ৫০টির মতো উপজেলা ও পৌরসভায় সম্মেলন হবে। গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত দুটি জেলায় সম্মেলনের তারিখ নির্ধারিত হয়েছে। গাইবান্ধায় ৬ অক্টোবর এবং রাঙামাটিতে ৮ অক্টোবর সম্মেলন হবে। ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারায় চুয়াডাঙ্গা, কুড়িগ্রাম, সুনামগঞ্জ, সিলেটসহ বেশির ভাগ জেলা থেকে সময় বাড়ানোর আবেদন জানানো হয়েছে। সে অনুযায়ী, বিশেষ করে পুনর্গঠনের কাজ শুরু হয়েছে এমন জেলাগুলোতে সময় বাড়ানোও হয়েছে। তবে পুনর্গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে যেসব জেলায় কাজ শুরুই হয়নি সেগুলোর সময় বাড়ানো হয়নি। একটি সূত্রের মতে, খালেদা জিয়া লন্ডন থেকে ফিরলে এদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।
দলের যুগ্ম মহাসচিব মোহম্মদ শাহজাহান জানান, যুক্তিসংগত কারণ দেখিয়ে যেসব জেলা থেকে সম্মেলনের সময় বাড়ানোর আবেদন করা হয়েছে তাদের সময় বাড়ানো হবে। এ ছাড়া যেসব জেলার সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ নেতারা কারাগারে রয়েছেন তাঁদের ক্ষেত্রেও সময় বাড়ানো হবে। কিন্তু যারা যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া সময় চায় এবং পুনর্গঠনের কাজই শুরু করেনি তাদের বিষয়ে দলীয় চেয়ারপারসন ও সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
২০০৯ সালের জাতীয় কাউন্সিলের পর ৩৮৬ সদস্যের নির্বাহী কমিটি ঘোষণা করে বিএনপি। পরে আরো কয়েকজনকে এ কমিটির সদস্যপদ দেওয়া হয়।
সবার আগে পরিবর্তন আসতে পারে স্থায়ী কমিটিতে : জানা গেছে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে আলোচনা এখন দলের নেতাকর্মীদের মুখে মুখে। ১৯ সদস্যের এই কমিটির অন্তত চারজন সদস্য বয়স ও স্বাস্থ্যগত কারণে দীর্ঘদিন ধরে দলে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছেন না। তাঁরা হলেন ড. আর এ গনি, এম শামসুল ইসলাম, সারোয়ারী রহমান ও এম কে আনোয়ার। এ ছাড়া কারাগারে আছেন ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী। কমিটির ১৯ নম্বর সদস্য তারেক রহমান প্রায় আট বছর যাবৎ লন্ডনে। ফলে গুরুত্বপূর্ণ অনেক ইস্যুতে এ কমিটির বৈঠক পর্যন্ত ডাকতে পারছেন না খালেদা জিয়া। দলীয় সূত্র মতে, এ কারণেই কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি পুনর্গঠন করা হলে সবার আগে স্থায়ী কমিটিতে পরিবর্তন আসবে।
গুরুত্বপূর্ণ পদে যাঁরা আসতে পারেন : বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে পরিবর্তন আনা হলে কারা নতুন অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন তা নিয়ে দলের বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনাও শুরু হয়ে গেছে। দলের নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে লবিং চালানোর পাশাপাশি সাম্প্রতিক দুঃসময়ে যাঁরা বিএনপির পাশে দাঁড়িয়েছেন এমন নেতাদের নামই এ আলোচনায় আসছে। তাঁদের মধ্যে এই মুহূর্তে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন দলীয় চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টু ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। এ দুজনই এই মুহূর্তে দলের শীর্ষ দুই নেতার সঙ্গে লন্ডনে অবস্থান করছেন। আমীর খসরুকে খালেদা জিয়া ঢাকা থেকে সফরসঙ্গী করে নিয়ে যান। আর মিন্টুকে ব্যাংকক থেকে লন্ডনে গিয়ে ‘স্ট্যান্ডবাই’ থাকতে বলেন খালেদা জিয়া। স্থায়ী কমিটি পুনর্গঠন হলে এ দুজন অন্তর্ভুক্ত হবেন বলে আলোচনা আছে। এ ছাড়া দলীয় চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. ওসমান ফারুকও যুক্তরাষ্ট্রে ও জাতিসংঘে তৎপরতা চালিয়ে খালেদা জিয়ার আস্থা অর্জন করেছেন। দলের নেতাকর্মীদের পক্ষে আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি রাজনৈতিক অঙ্গনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে খালেদা জিয়ার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছেন তাঁর উপদেষ্টা সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন। স্থায়ী কমিটির সম্ভাব্য সদস্য হিসেবে এই দুজনের নামও আলোচনায় আছে।
এদিকে রাজনীতিতে দলের স্থায়ী কমিটির বর্তমান অনেক সদস্যের চেয়েও সিনিয়র ও যোগ্য হিসেবে পরিচিত বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান ও সাদেক হোসেন খোকা। দলে তাঁদের অনুসারী বা সমর্থকের সংখ্যাও অনেক। স্থায়ী কমিটিতে এ দুজনের অন্তর্ভুক্তির সম্ভাবনাও যথেষ্ট। এ ছাড়া স্বাস্থ্যগত কারণে সারোয়ারী রহমান বাদ পড়লে নারী হিসেবে বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান স্থায়ী কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন বলে দলের অনেকে মনে করছেন।
সূত্র মতে, যুগ্ম মহাসচিবদের মধ্য থেকে একজনকে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব করা হতে পারে। এ তালিকায় মোহম্মদ শাহজাহান ও রিজভী আহমেদের নাম আলোচনায় আছে। সাম্প্রতিক সময়ে দল পুনর্গঠনের বিষয়ে শাহজাহানকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছেন খালেদা জিয়া। রিজভী কারাগারে আছেন।
এদিকে দলের ভাইস চেয়ারম্যান ও উপদেষ্টাদের মধ্যে নিষ্ক্রিয়দের বাদ দেওয়া হবে বলে জানা গেছে। সূত্র মতে, সরকারবিরোধী আন্দোলনে ‘গা বাঁচিয়ে’ চলায় ওই দুই কমিটির বেশ কয়েকজন সদস্যের পাশাপাশি অঙ্গসংগঠনের দু-একজন নেতা এবং নির্বাহী কমিটির অনেক সদস্যের ভূমিকায় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান দুজনই ক্ষুব্ধ। সব মিলিয়ে নির্বাহী কমিটিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হতে পারে। কালের কণ্ঠ


শেয়ার করুন