আজ সোনালী কাবিন'র কবির ৩য় মৃত্যু বার্ষিকী

আল মাহমুদ কবিতার খাতায় এঁকেছেন আধুনিকতা ও বাঙালিয়ানার চিরায়ত ছবি

ইসলাম মাহমুদঃ

আজ বাংলা সাহিত্যের সোনালী কাবিন’র কবি নামে খ্যাত আল মাহমুদের তৃতীয় মৃত্যু বার্ষিকী। বাংলা সাহিত্য়ের প্রধান এই কবি ২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির এই দিনে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পাড়ি জমান লোক লোকান্তরে। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিলো ৮২ বছর।
বাংলা সাহিত্যে অনবদ্য কালজয়ী কাব্য সোনালী কাবিন এর স্রষ্টা ও বাংলা ভাষার গুরুত্বপূর্ণ কিংবদন্তি কবি ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোড়াইল গ্রামের এক ব্যবসায়ী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বেড়ে উঠেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়। পরবর্তীতে কবিতা ও জীবিকার টানে আজীবন থেকেছেন রাজধানী ঢাকায়।

আল মাহমুদ এমনই শক্তিমান একজন কবি, যিনি ছন্দের প্রায়োগিক ব্যবহারে সাবলীল ভঙ্গিতে কবিতা বা ছড়াকে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছেন। অহেতুক ছন্দ মেলানোর প্রয়াসে কবিতার মেজাজকে কখনোই হারিয়ে ফেলেননি তিনি। অযথা ছন্দকে প্রয়োগ করে জাদুকরী কাহিনী লেখেননি কখনোই। তাঁর ভাবনার মধ্যে সর্বদা স্পষ্টবাদী চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে। ভাষার জন্য কবিতা বা স্বাধিকারের জন্য কবিতা বা স্বাধীনতার জন্য, কোথায় নেই কবি! কোথায় নেই তাঁর ছন্দময় কবিতা। ছোটদের-বড়দের সবার কাছেই সমানতালে প্রকাশ করেছেন তাঁর ভাবনা আর অভিব্যক্তি। ‘আম্মা বলেন পড়রে সোনা/আব্বা বলেন মন দে/ পাঠে আমার মন বসে না/কাঁঠাল চাঁপার গন্ধে।’ কি মাধুর্য মিশ্রিত কথা। শিশু-কিশোর মনোতোষ ভাবনা। আবার ভাষা আন্দোলনের ছড়ায় বলেছেন, ‘ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ/ দুপুর বেলার অক্ত/ বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি কোথায় / বরকতেরই রক্ত।’ কী অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। লাঠি মিছিল করেননি, গুলি ছোড়েননি। কিন্তু গুলিতে নিহত বরকতদের রক্তে যেন ভিজে গেছে আকাশ, মেঘ, ঝরে পড়ছে রক্তিম বৃষ্টি হয়ে। স্বাধিকারের অন্দোলনে ঊনসত্তরের ছড়াতে বেদনা মিশ্রিত শোকগাথা পাই। আবার তৎক্ষণাৎ জ্বলে ওঠেন- ‘কোথায় পাবো মতিউরকে/ ঘুমিয়ে আছে সে/ তোরাই তবে সোনা মানিক/ আগুন জ্বেলে দে।’ এই ছড়ার ঠিক উপরাংশে উদ্বীপ্ত আছে ‘কেনো বাঁধবো দোর জানালা/ তুলবো কেনো খিল?/ আসাদ গেছে মিছিল নিয়ে/ ফিরবে সে মিছিল/’ কি প্রত্যয়ী কথা। এভাবে বাংলাদেশে জন্মবেদনা থেকে স্বাধীনতার স্বাদ। প্রতিটি ক্ষেত্রেই আল মাহমুদ দু’হাত ভরে বিছিয়ে দিয়েছেন কবিতার লাইন। ‘আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেছে শেষে/হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে/…/এলিয়ে খোঁপা রাত্রি এলেন, ফের বাড়ালাম পা/ আমার মায়ের গয়না ছাড়া ঘরকে যাবো না।’ এরকম দৃঢ়তার জন্য শক্তি মত্তার প্রয়োজন। কবির কব্জিতে জোর ছিল। ছিল মোচড় দেয়ার দক্ষতা। শব্দ তরঙ্গের এমন মূর্ছনা সৃষ্টির রহস্যের পেছনে ছিল কবির আত্মবিশ্বাস। জাতীয়তাবাদী চেতনা, দেশপ্রেম, দেশ মাতৃকার প্রতি অঢেল অকৃত্তিম ভালোবাসা। পার্থিব লেনদেনের চেয়ে তিনি দাঁড়িপাল্লায় তুলে দিয়েছেন তাঁর আসাধারণ সব শিল্পকর্ম। আর প্রাত্যহিক জীবনে যা সঞ্চয় করেছেন সব বিলিয়ে দিয়েছেন উদারহস্তে। তবে উদারতার কাব্যকাঁথায় সূঁচাল কারুকাজ করে নকশা আঁকতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি। কারণ তিনি ছিলেন কবি। আধুনিক কবি। অপরাজিত কবি। ‘পরাজিত নয় নারী, পরাজিত হয় না কবিরা।’ অসাধারণ সব বাক্যবাণে তথা কথিক ক্লাসিক সমালোচকদের বুঝিয়ে দিয়েছেন আধুনিকতার স্বাতন্ত্র্যতা এবং নিজস্বতা। স্বকীয়তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন পাঠকদের। প্রায় কবিতার মধ্যেই তিনি কবিতার ভেতরে থেকেই বাঁক-বদল করেছেন।

রবীন্দ্র উত্তর আধুনিককালের কবিদের মধ্যে যিনি শব্দচয়নে, জীবনবোধে, শব্দালংকারের নান্দনিকতায়, বর্ণনায় অসামান্য আর ধ্রুপদী, তিনি কবি আল মাহমুদ।

যিনি দীর্ঘ সময় ধরে কবিতার খাতায় এঁকেছেন বাঙালিয়ানার এক চিরায়ত ছবি। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবিদের দলে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে এই কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। কালের কলসের পরে ‘সোনালী কাবিন’ কাব্যগ্রন্থটি একটি মাস্টারপিস হিসেবেই সমাদৃত হয়েছে, এমনকি কবির একচোখা সমালোচক ও নিন্দুকদের মাঝেও। এই কাব্যগ্রন্থটি অনুবাদ হয়েছে অনেকগুলো ভাষায়। এতে প্রতিটি কবিতার শব্দ ব্যবহারের স্বতঃবেদ্য স্বাভাবিকতা এবং বিশ্বাসের অনুকূলতা নির্মাণে তিনি নিঃসংশয়ে আধুনিক বাংলা ভাষায় অন্যতম কবি। আর এমন কবিই উচ্চারণ করেন:

আমরা তো বলেছি আমাদের যাত্রা অনন্ত কালের।
উদয় ও অস্তের ক্লান্তি আমাদের কোন দিনই বিহ্বল করতে পারেনি।
আমাদের দেহ ক্ষত-বিক্ষত,
আমাদের রক্তে সবুজ হয়ে উঠেছিল মূতার প্রান্তর।
পৃথিবীতে যত গোলাপ ফুল ফোটে তার লাল বর্ণ আমাদের রক্ত!

উপরে উল্লেখিত সৃষ্টিতে বিশ্বাসীদের অনুভূতিকে কবি তার কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন আলোকিত চেতনার আবেগ। তার সেই চেতনাকে মূর্ত করেছেন শব্দে, অনুভূতির অবয়বে। কবিতায় ফুটে উঠেছে তার বিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি, প্রকাশ পেয়েছে দৃঢ়তা আর জীবনের গন্তব্য, তাতে নেই সংশয়, শঙ্কা।

এইভাবে আমরা দেখি আধুনিক কবিতার একটি মৌলিক বিষয় শব্দের সমাহার বা চিত্রকল্পের ব্যবহার। এ ক্ষেত্রে আল মাহমুদ গ্রাম বাংলার সৌন্দর্যকে আশ্চর্য শক্তিময় শব্দ বিন্যাসে উপস্থাপন করেছেন। স্পন্দমান আবেগের ভূগোল, দেশজ চেতনা, লোককাহিনী ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর সৌন্দর্যে আপ্লুত আল মাহমুদ একজন মিথলজিক্যাল রোমান্টিক কবি। যেমন তিনি তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ‘সোনালী কাবিন’ এ মাতৃভূমির ইতিহাস খনন করে তুলে এনেছেন ঐশ্বর্যময় ও বীর্যবান অনুষঙ্গসমূহ। তিনি এখানে শক্তিমত্তার সঙ্গে রোমান্টিসিজম প্রবেশ করিয়েছেন যা ‘সোনালী কাবিন’ সনেট গুচ্ছকে করেছে অন্যান্য।

সোনার দিনার নেই, দেন মোহর চেয়ো না হরিণী

যদি নাও, দিতে পারি কাবিনহীন হাত দুটি

আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনকালে সঞ্চয় করিনি

আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি;

ছলনা জানিনা বলে আর কোন ব্যবসা শিখিনি।


শেয়ার করুন