আলিকদমের মারায়ন থং-কে বলা যায় মেঘের ভেলা

সাজেক-কে যদি বলা হয় মেঘের রানী, তাহলে মারায়ন থং-কে বলা যায় মেঘের ভেলা…

মারায়ন তং/মারায়ন ডং/মেরাই থং-সবই একই স্থান। যদি নিতে চান দুধসাদা মেঘের ছোঁয়া, রাতের আকাশে সহস্রাধিক তারার আলোর ঝলকানি, হাড়কাপানো ঠান্ডায় প্রচন্ড বাতাসের লিলুয়া শব্দ তাহলে ২ ঘন্টার পাহাড়ি পথ ট্রেকিং করে চলে যান মেরাই থং জাদি, ওখানে থাকা বা খাওয়ার কোন ব্যবস্থা নাই, তাই তাবু, খাবার তৈরির সরঞ্জামাদি, পানি ও আনুসাঙ্গিক জিনিসপাতি নিয়ে আজই বেরিয়ে পড়ুন।বর্ষা/শীতকালে গেলে অবশ্যই ভারী কাপড় নিতে হবে। খোলা পাহাড় বিধায় প্রচন্ড বাতাস আর হিম শীতল ঠান্ডা।

প্রায় মাসখানেক আগে থেকেই প্ল্যান করছিলাম কোথায় গিয়ে ক্যাম্পিং করলে তারাভরা খোলা আকাশ দেখা যাবে, সকালে ঘুম থেকে ঊঠেই অসাধারণ কোন ভিউ পাওয়া যাবে তা নিয়ে চলছিল নানা জল্পনা-কল্পনা… যাই হোক অনেক ঘাটাঘাটির পর আর অপু নজরুল ভাই আর ইকবাল জাবেদ ভাই থেকে যথেষ্ট তথ্য নিয়ে কনফার্ম হয়ে সবার সাথে আলোচনা করে ঠিক করে ফেললাম এবার আমাদের ক্যাম্পিং হবে মারায়ন থং জাদিতে আর পরদিন আলীর গুহা অভিযান শেসে ঘরে ফেরা।

আমাদের ১৩ জন দলের যাত্রা শুরু হল ১৫ ডিসেম্বর সকাল ৭ টায় চট্রগ্রাম নতুন ব্রীজ থেকে, শুক্রবার আর পরপর ২দিন সরকারি ছুটি(বিজয় দিবস)থাকায় সকাল থেকেই নতুন ব্রীজ এলাকায় প্রচুর ভিড়(কক্স’বাজারের যাত্রি বেশি), যেকারনে আমরা চকরিয়ার উদ্দেশ্যে ১৫০টাকার ভাড়া ২৫০ দিয়ে ঊঠে গেলাম বাসে,আগে থেকেই নাস্তা কিনে রেখেছিলাম তাই বাসেই সকালের নাস্তাটা সেড়ে নিলাম,১০:৩০ টার দিকে পৌঁছুলাম চকরিয়া বাজারে, ওখান থেকে ৫ মিনিটের মতো হেঁটে গেলাম টার্মিনাল এলাকায়।সেখানে ১টা হোটেলে ব্যাগ-বস্তা রেখে আমরা তিনজন বেড়িয়ে পড়লাম মুরগী আর টুকিটাকি জিনিসপাতি কেনার জন্য, বাকিরা যে-যার মতো নাস্তা/ভাত খেয়ে নিল কারণ এরপর আমদের আর কোথাও থামা হবেনা। দুপুর ১২ টার দিকে আমরা ১৪০০ টাকা(অন্যান্য সময় ৯০০/১০০০ দিয়েই রাজি হয়ে যায়)দিয়ে ১টা জীপ ভাড়া করে রওনা দিলাম মারায়ন থং জাদির উদ্দেশ্যে। পাহাড়ি উঁচুনিচু রাস্তা আর নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে দেখতে ১.৫ ঘন্টায় পৌঁছে গেলাম আলীকদম আবাসিক(আলিকদম বাজারের অনেক আগে)-ডানদিকে গ্রামের রাস্তা শেষে আদিবাসীদের পাড়ার সামনে জীপ আমাদের নামিয়ে দিল -এরপর ২ ঘন্টার ট্রেকিং শেষে ৩:৪০-এ মারায়ন তং জাদিতে পৌঁছুলাম।খাড়া পাহাড়ি পথে ট্রেকিং করতে কিছুটা ক্লান্তি লাগলেও শেষসীমায় পৌঁছে প্রকৃতির খুব কাছে এসে মনে হলো দুর্লভ কিছু হাতে পেয়েছি।

প্রায় ১৬৪০ ফুট উপরে শুভ্র মেঘের চাদরে ঢাকা এই জাদিটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয় কেন্দ্র। খানিকক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে শুরু হল আমাদের তাঁবু বিছানোর পালা, কেউ গেল লাকড়ি কুঁড়াতে, কেঊ চুলা বানানোর ব্যবস্থা করল। কেউ কেউ ছবি তুলতেও ব্যস্ত হয়ে পড়লো।গোধূলির সূর্যাস্ত, সন্ধ্যার হিম ঠান্ডায় ধোঁয়া উঠানো স্যুপ আর পপকর্ন ভাজা, রাতের কনকনে বাতাসে বসে সুস্বাদু বিরিয়ানি রান্না আর টপাটপ গলাধঃকরণ করা, হাঁড়কাপানো শীতের রাতে আকাশ ভরা তারার মিটমিট আলোয় ক্যাম্পফায়ার, আড্ডা, গান, নাচ ও তাঁবুতে অবকাশযাপন। ঠান্ডায় খুব ১টা ঘুম হলনা,বাতাসের শব্দে বাড়বার ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছিল। ভোরের কুয়াশাচ্ছন্ন সূর্যোদয়(৫.৩০) দেখা, সূর্যের কমলা আভায় অদ্ভুত এক মায়ামাখানো সকাল, আর পাহাড়ের নিচে মেঘেরদেশ দেখে ইচ্ছে হচ্ছিলো টুপ্পুস করে ডুব দেয় মেঘের ভাঁজে।

নিরাপত্তা নিয়ে তেমন ১টা চিন্তা করার দরকার নাই, আমাদের সাথে ১জন ফিমেল ছিল, আর আমরা কোন গাইডও নেইনি।

১ দিন ক্যাম্পিং শেষে পরদিন ক্যাম্প গুছিয়ে পাহাড়ের নিচে আসার পথে আদিবাসীদের সাথে কথা বলা, ছবি তোলা আর গ্রামের রাস্তার পাশেই ব্রেকফাস্ট সেরে রওনা দিলাম রহস্যময় আলীর সুড়ঙ্গ অভিযানে। নদীর বাঁক ও উচুনিচু পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়েই পৌঁছে গেলাম আলীর গুহার মুখগহ্বরে. যাওয়ার সময় সুড়ঙ্গপথটি দেখলে মনে হবে দুপাশ থেকে পাহাড়গুলো কেউ কাওকে জায়গা ছাড় দিতে রাজিনা. রোদের হালকা আলো অন্ধকারে থাকায় সারাবছর পাহাড় ও গুহার সুড়ঙ্গপথ ভেজা, স্যাঁতসেতে আর কর্দমাক্ত পানি থাকে।

আলীর গুহা যাবার পথে পড়ে মাতামুহুরি নদীর শাখা বেস্টিত তৈন খাল, অদ্ভুত সুন্দর সে খাল, আশপাশে চাষ হয় তামাক পাতা।

তৈন খালের আগে গ্রামের এক বাড়িতেই আমরা দুপুরের খাবার খেলাম(ভাত,ডাল,ডিম,শুটকি মিশ্রিত সবজি)। এরপর আমাদের ফেরার পালা, ওখান থেকে প্রথমে টমটম করে আলিকদম বাজার- জীপ ভাড়া করে(৯০০টাকা) চকরিয়া- চকরিয়া থেকে নতুন ব্রীজ(২০০টাঁকা)- এরপর সবাই সবার সাথে বিদায় নিয়ে আর রোমাঞ্চকর ভ্রমনের অভিজ্ঞতা নিয়ে বাসায় ফিরলাম প্রিয় চট্রগ্রাম নগরীতে।

আমরা ১৩জন ছিলাম বলে ২দিনের ট্যুরে আমদের সর্বমোট খরচ হয়েছিল ১০৬০ টাকা।

চকরিয়াতে(আমিরাবাদ হোটেলে)আমাদের দুপুরের খাবারে(ভাত,ডাল,ডিম আর সবজী=৪০/-) খরচ বেশি নিয়েছিল(মোট-৯০০টাকা=১৩জন) যেখানে আমরা ১৬ ডিসেমবর আলিকদমে গ্রামের বাড়িতে আরো মজা করে খেয়েও বিল এসেছে ৭০০টাকা!!!

জিপ ভাড়া=(চকরিয়া-আলিকদম মারায়ন তং পাহাড়ের নীচে=১৪০০টাকা)
(আলিকদম বাজার-চকরিয়া=৯০০টাকা)

রাতে আমরা তাবুতে ছিলাম আর তাবু, খাবার তৈরির সরঞ্জামাদি,চুলা,পানি ও আনুসাঙ্গিক জিনিসপাতি সঙ্গে নিয়েছিলাম বলে খরচটা অনেক কম হয়েছে।

সবশেষে ২টা মানুষকে ধন্যবাদ না দিলেই নয়-১)সঙ্গয়’দা- অতি যত্নসহকারে অধিক ধৈর্য নিয়ে সকল খাবার তৈরি করা, ট্যূরের সকল দায়িত্ব নিজ কাঁধে নেওয়া এবং সবার খেয়াল রাখা।
২)সজীব’দা- ঊনিও অনেক যত্নসহকারে ঠান্ডার মধ্যে গরম গরম স্যুপ আর স্পেশাল সালাদ বানানোর জন্য এবং সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জীবনের পাতায় লিখে দেয়ার মতো ১টি সফল পরিভ্রমেন সাথে থাকার জন্য…..

তবে যেখানেই যান পরিবেশ নস্ট করবেননা, পলিথিন, খাবারের উচ্ছিষ্ট, পচনশীল দ্রব্য একযায়গায় রেখে সঙ্গে নিয়ে এসে ময়লা ফেলার স্থানে ফেলবেন। কোন নেশাদ্রব্য সাথে নিয়ে পাহাড় ও নিজেদের সৌন্দর্যহানি করবেন না, আদিবাসীদের সাথে খারাপ আচরণ করবেননা।

লেখকঃ দিদারুল হক আইটি অফিসার, ইয়ংওয়ান, সিইপিজেড, চট্রগ্রাম


শেয়ার করুন