আমি একজন মানবপাচারকারী

2015_09_20_14_50_54_TFtL2Xwossxyem3qfD6UGpLO0K6PQB_256xautoসিটিএন ডেস্ক :

আবু মাহমুদ এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি ধনী। সিরিয়ার আলেপ্পো শহরে তিনি যখন পেশায় ডাক্তার ছিলেন, সেই তুলনায় এখন তার উপার্জন অনেক বেশি। সিরিয়া থেকে ইউরোপে মানবপাচার করে মাসে প্রায় এক লাখ ডলার উপার্জন করছেন আবু মাহমুদ। যদিও তিনি বেশ ভালো করেই জানেন এটা খুব একটা স্বাভাবিক জীবন নয়। যুদ্ধের বাজারে এখন প্রতিটা দিন তার কাটছে ভয়াবহ ব্যস্ততায়। তারপরেও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফের এক সাংবাদিক ইস্তামবুলের এক ক্যাফেতে বসে আবু মাহমুদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন, তখনও আবুর তিনটি ফোনে ক্রমাগত ফোন আসছিল।

মজার বিষয় হলো, আবু মাহমুদ যে একজন মানবপাচারকারী তা মোটামুটি চায়ের দোকানদার থেকে শুরু করে সবাই জানেন। কখনও কোনো বিপদে আটকে গেলে অদেখা কিছু বন্ধুর সহায়তা পান তিনি। যে কারণে যেকোনো পক্ষের কাছেই তিনি বেশ বিশ্বাসযোগ্য একজন মানুষ। সারাদিনে তার কাছে যতগুলো ফোন আসে সেগুলোর মধ্যে অর্ধেকই হলো বিভিন্ন খদ্দেরের। এছাড়াও সীমান্তে যারা কাঁটাতারের বেড়া ডিঙ্গোতে শরণার্থীদের সহায়তা করেন তারাও তাকে ফোন দেয় নিয়মিত। তবে আবু মাহমুদ নিজেও জানেন যে, তার ফোন নিয়মিত পুলিশ সদস্যরা ট্র্যাক করছে। তাই মাঝে মধ্যে যে পুলিশের সঙ্গে বচসা হয় না তার, ব্যাপারটা অতটা সরল নয়।

সাক্ষাতকার চলাকালীন সময়েই এক পরিবার তাকে ফোন দেয় ইউরোপে যাবার জন্য। ফোনের উত্তরে আবু তখন বলেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত তোমার ভাইয়ের টাকা হাতে না পাচ্ছি ততক্ষণ পর্যন্ত সম্ভব নয়।’ মানে হলো, এর আগে এই পরিবারটির এক সদস্য কোনো অর্থ ছাড়াই ইউরোপে পাড়ি জমিয়েছিল এবং কথা ছিল সেখানে যাবার পর আবু মাহমুদকে নির্দিষ্ট টাকা দেয়া হবে। কিন্তু ইউরোপে পা রাখার পরেও এখনও সেই টাকা পাননি আবু। তাই টাকা ছাড়া নতুন করে ঝুঁকি নিতে রাজি নন তিনি। কারণ তুরস্কের রাজধানী শহরে বসে এরকম ব্যবসা চালানো অতটা সহজ কাজ নয় কিন্তু। প্রায় একদিন অন্তর অন্তর পুলিশ সদস্যরা তার কাছ থেকে প্রায় এক হাজার ডলার করে নিয়ে যায় ঘুষ হিসেবে।

আলেপ্পো শহরের একজন প্রসিদ্ধ ডাক্তার হওয়া স্বত্ত্বেও যুদ্ধের বাস্তবতা তাকে এই মানবপাচার করতে বাধ্য করছে। তিনি সিরিয়ার যুদ্ধাবস্থার মধ্যে আটকে থাকা মানুষকে টাকার বিনিময়ে ইউরোপে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেও বিশ্ব আইনী ব্যবস্থার কাছে তিনি অপরাধী। ইতোমধ্যে ইন্টারপোলের অপরাধী তালিকায় তার নাম উঠে গেছে। যদিও আবু মাহমুদ নামটি তার আসল নয়। বর্তমানে তিনি তার্কিশ শহর মেরসেইনে কাজ করছেন। সেখানে তার নিজের বেশ কয়েকটি বিশাল আকারের নৌকা আছে, এর এক একটি নৌকায় কমপক্ষে কয়েকশ মানুষ সাগর পাড়ি দিতে পারে।

২০১২ সালের কথা। প্রেসিডেন্ট আসাদের বিরুদ্ধে ততদিনে লড়াইয়ে বেশ শক্তিশালী অবস্থান নিয়ে নিয়েছে বিদ্রোহী সেনারা। আলেপ্পো শহরের একাংশ তারা দখল করে নিয়েছে ততদিনে। আলেপ্পোর এই যুদ্ধের ময়দানে নিজের পেশার প্রতি সম্মান জানিয়ে বিদ্রোহী-আসাদপন্থী দুই পক্ষের আহতদেরই চিকিৎসা করতেন তিনি। কিন্তু আসাদ সরকারের এটা পছন্দ হলো না। সরকারি বাহিনী তাকে খুঁজতে শুরু করে। আর তখনই মূলত আবু মাহমুদ জীবন বাঁচানোর জন্য আলেপ্পো ত্যাগ করেন এবং এই পেশায় প্রবেশ করেন।

আলেপ্পো থেকে পালানোর পর তিনি তুই চাচাতো ভাই এবং এক বন্ধুকে নিয়ে নৌকায় করে চললেন ইউরোপের উদ্দেশ্যে। কিন্তু সাগরে নিজের চোখের সামনে তিনি নারী এবং শিশুদের ডুবে যেতে দেখলেন। আবু এবং চাচাতো ভাইরা টানা ১১ ঘণ্টা সাতার কেটে ডাঙ্গায় উঠলেন। এরপরও কয়েকবার পরিবার সমেত চলে যাওয়ার চেষ্টা করেন কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। ততদিনে মানবপাচারকারী কয়েকজনের সঙ্গে তার ভালো যোগাযোগ তৈরি হয়। তারা আবুকে এই কাজে উৎসাহিত করার চেষ্টা করে। সবচেয়ে বড় কথা আবু পেশায় একজন ডাক্তার ছিলেন জানার পর সকলেই তাকে বিশ্বাস করতে এবং ভালোবাসতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে নিজের পরিবারকে বাঁচানোর জন্য এই কাজে নামেন আবু মাহমুদ।

‘আমি প্রতিজনকে গ্রিসে পৌছে দেয়ার বিনিময়ে এগারশ ডলার নেই। আর জার্মানি পৌছে দিতে লাগে দুই হাজার ইউরো। তবে সুইডেন, নরওয়ের মতো দেশে যেতে হলে কমপক্ষে তিন থেকে চার হাজার ইউরো লেগে যায়। আমি শুধু ইউরোপকে এই বার্তাটিই পৌছে দিতে চাই যে, আপনারা যদি সকল সীমান্ত বন্ধও করে দেন তবুও শরণার্থীরা যেতে থাকবে। তারা প্রয়োজন হলে সুরঙ্গ খুড়ে চলে যাবে’-আবু মাহমুদের ভাষ্য।


শেয়ার করুন