আমাদের ইসলামের জানবাজ মোল্লাগণ?

মোল্লারা সমাজে নিজেদের আল্লাহর পেয়ারা বান্দা হিসেবেই তুলে ধরেন। মুখে উচ্চারণ না করলেও তাদের হাবেভাবে, চাল চলনে এই ভড়ংটুকুই ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। কিন্তু যে নিজেকে আল্লাহর প্রিয় রূপে তুলে ধরতে ভালবাসে, যে মানুষের মধ্যে আল্লাহর প্রেম আছে, যার হৃদয় মন আল্লাহর প্রেমে পরিপূর্ণ, যে বিশ্বাসী, সে তো কখনও আল্লাহর সৃষ্টির প্রিয় না হয়ে পারেনা। একজন প্রকৃত ধার্মিকের মৌললক্ষ্যই তো – মনুষ্যত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ। তার সাধনা – প্রসন্ন দৃষ্টিতে খোদার সৃষ্টির বৈচিত্র্য ও আপাত অসঙ্গতির অন্তর্নিহিত নিগুঢ়তত্ব অনুধাবন ও উপলব্ধির চেষ্টা করা। তার উপাসনা – বিস্ময় বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে প্রেমাপ্লুত হৃদয়ে মহিমাময় কুশলী স্রষ্টার প্রতি আতœনিবেদন করা। একারণেই যথার্থ ধার্মিক প্রেমিক ও সহিষ্ণু না হয়ে পারেনা। ধার্মিকের কাছে তাই মানুষ করুণা আর মৈত্রীর প্রত্যাশাই করে – ঘৃণা, বিদ্বেষ কিংবা ধর্মের নামে অধর্মের জুলুম নয়। সমাজ স্রষ্টা ও সৃষ্টি প্রেমিক ধার্মিকই চায়। সাম্প্রদায়িক কিংবা দলীয় নেতারূপী শাস্ত্র বিদ্যা বিশারদ নয়।

কিন্তু বন্যা, খরা, দুর্ভিক্ষ, মহামারী প্রভৃতির ভীষণ প্রকোপে যখন লক্ষ লক্ষ নর নারীর জীবন বিপন্ন হয়ে উঠে তখন সেই অসহায়, বিপন্ন মানবতার সেবা ও সাহায্যে আমাদের কোন্ মোল্লা, মাওলানা সাহেব, কোন্ পীর বুজুর্গ সাহেব এগিয়ে আসেন? তারা কেউ এগিয়ে আসেন না। কারণ ওসব তাদের দায়িত্ব কর্তব্যের আওতায় পড়েনা। তাদের কর্তব্য হচ্ছে বিপদ আসার আগে মসজিদে বসে দোয়া দরূদ, নফল নামাজ পড়ে সুদীর্ঘ মোনাজাত ধরে খোদার পানাহ্ চাওয়া আর বিপদ ঘাড়ের উপর এসে পড়লে দুকানে তর্জনী ঢুকিয়ে গগন বিদারী কণ্ঠে আজান দিতে শুরু করা। অতঃপর বিপদের ভয়াবহ ধ্বংসলীলা পর্যায়ে তাদের আপাততঃ আর কোন দায়িত্ব নেই ।এই পর্যায়ে সকল দায়-দায়িত্ব ঐ ইহুদী-নাসারা কিংবা তাদের দেশী, বিদেশী ত্রাণ সংগঠন সমূহের । রেডক্রস বা রেডক্রিসেন্ট দূর্গত এলাকায় ত্রাণকার্য চালাবে, সরকারী মিডিয়াসমূহ ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ আর গণ্যমান্যদের ত্রাণ বিতরণের চিত্র প্রচার করবে, বিদেশী রাষ্ট্র প্রধানেরা শোকবাণী প্রদান করবে, নাসারা নৌ সেনারা ‘অপারেশন সী-এঞ্জেল’ জাতীয় কিছু চালিয়ে বিধ্বস্ত অবকাঠামো পুনঃ নির্মাণে তাৎক্ষণিক সহযোগিতা প্রদান করবে, ছোটবড় ঘ.এ.ঙ রা তাদের শক্তি সামর্থ্য দিয়ে মানুষকে উঠে দাড়াতে সাহায্য করবে ( হয়তো উঠে দাঁড়াতে পারলে তাদের স্ব-স্ব ধর্মের অনুসারী বাড়াতে পারবে এই আশায়? )।

এক সময় ধীরে ধীরে বাতাস থেকে সময় এসে মুছে দিবে লাশের গন্ধ, সজন হারানোর আর্তনাদ আর ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা। এই পর্যায়ে আমাদের নায়েবে নবীগণ তাদের দায়িত্ব সচেতনতায় সোচ্চার হয়ে উঠবেন। নড়ে চড়ে বসবেন ধর্ম ব্যবসার গদিতে। ‘লালসালু’ র পাতা থেকে মজিদের লাশ বেশে উঠে এসে বলবেন – খোদার উপর তোয়াক্কল রাখো। মানুষকে বুঝাবেন – এসবই ছিল তাদের প্রতি এক কঠোর পরীক্ষা। তাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত কিংবা কর্মফল। সব ল্যাঠা চুকে গেলে ‘পর শুরু হবে ঘ.এ.ঙ বিরোধী মিছিল আর ইহুদী, খ্রীস্টান সাম্রাজ্যবাদী ও তাদের এদেশীয় তথাকথিত দালালদের বিরুদ্ধে গালাগালি।

পার্বত্য লুসাই হিল, আসামের গারো, খাসিয়া, নাগা, হিমালয়ের নেপালী, ভূটানী, সাওতাল পরগনার কোল, ভিল প্রভৃতি অঞ্চলের লক্ষ লক্ষ পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠীকে খ্রীস্টান পাদ্রীরা খ্রীস্টধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করে, তাদের মধ্যে শিক্ষা ও সভ্যতা বিস্তারে নিরলস পরিশ্রম করেছেন । বার্মায় তারা ‘কেরাইন’ নামক পুরো একটি সম্প্রদায়কে সম্পৃর্ণরূপে খ্রীস্টান ধর্মে দীক্ষিত করে ফেলেছে। তাদের মধ্যে এখন নিরক্ষর কোন লোক আছে কিনা সন্দেহ। তাদের স্কুল, কলেজ, হোস্টেলের শান শওকত দেখে হা হয়ে যেতে হয়। খ্রীস্টান মিশনারীরা পৃথিবীর কয়েকশত ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করে কোটি কোটি সংখ্যায় তা প্রচার করেন। অসভ্য জাতিদের ভাষায় লেখা ও পড়ার উপযুক্ত বর্ণমালা সৃষ্টি করে তাদের মধ্যে ধর্ম প্রচার ও সভ্যতা বিস্তার করে চলেছেন।

আর বিপরীতে আমাদের ইসলামের জানবাজ মোল্লাগণ? না। তারা অতো হাঙ্গামায় নেই। তাদের মত, পথ উভয়ই খুবই সরল এবং পরিস্কার। ধারণাও অনেক প্র্যাকটিক্যাল। অন্যান্য সম্প্রদায়ের বেখাপ্পা মানুষ গুলোকে নিয়ে এতো টানাটানি না করে এনারা তার চাইতে আপন ঘরে মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধি করতেই অধিক তৎপর। আর ধর্ম পুস্তকের প্রচার? খোদ বাংলাদেশের শতকরা ৮০ জন মুসলমান স্বচক্ষে কোনদিন কোরআনের বাংলা অনুবাদ দেখেছেন কিনা সন্দেহ, পড়াতো দূরের কথা।

আফসোস্। যে জাতি একদিন নির্যাতিত এবং অজ্ঞানান্ধ মানবজাতির সেবা ও কল্যাণ কামনায় নিঃশেষে সর্বশক্তি নিয়োগ করে এই বিশ্বকে বিমুগ্ধ করেছিল, যে জাতির প্রেম ও পরোপকারের বিকাশ দেখে বিশ্বের মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় ইসলামের শান্তিছায়ায় দলে দলে ছুটে এসেছিল – সে জাতির আজ একী দূর্দশা? পৃথিবীব্যাপী আজ বিনা বাধায় চলছে মুসলিম নির্যাতন। নিজের দেশে চলছে অজ্ঞানের হা-হুতাশ, ব্যথিতের ক্রন্দন, ক্ষুধিতের হাহাকার আর প্রপীড়িত নিপীড়িত মানুষের করুণ ক্ষীণ আর্তনাদ। জাতির এই ঘোরতর দূর্দিনে আজও আমাদের মোল্লাগণ নিজেদের ভূবনেই বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছেন। যারা পেটের তাগিদেই হোক কিংবা ধর্মের তাগিদেই হোক – এই জাতির ধর্মীয় কর্ণধার সেজে বসেছেন, তাদের কে বুঝাতে যাবে যে, সারাদিন মসজিদে বা দরগাহে বসে জপতপ করলে কিংবা লম্বা লম্বা বক্তৃতা দিলে জমিতে এক মুঠো ফসল ফলবেনা? কোন্ পাগল তাদের জ্ঞান দিতে যাবে যে, এই যে প্রতিনিয়ত তারা রোঁয়া উঠা, চামড়া ঝুলে পড়া, শক্তি শৌর্য্যহীন নেড়ি কুত্তার মতো বৃহৎ অমুসলিম শক্তিবর্গের বিরুদ্ধে গলা ফাটিয়ে ঘেউ ঘেউ করে মরছে তারা যদি কানের পট্টি ফাটানো চড় মারার ভঙ্গীতে মিগ্ কিংবা স্টেলথ্ এ চাপিয়ে ‘লিটল বয়’ অথবা ‘ফ্যাটম্যান’ জাতীয় কিছু একটা ছেড়ে দিয়ে যায় তাহলে তাদের চৌদ্দ পুরুষের কেউই রক্ষা পাবেনা? কোন মসজিদ, কোন দরগাহে বা কোন খান্কায় জায়নামায আকড়ে থাকা কোন পীর, মুর্শীদ, বুজুর্গই রক্ষা পাবেনা? কিংবা তাদের এবাদত বন্দেগীতে তুষ্ট হয়ে খোদার পক্ষ থেকে কোন জীবরাঈল ফেরেস্তা এসে তার সীমার জুলুম বিস্তৃত কোন পাখা ছাড়িয়ে তাদের রক্ষা করবে না?

কারণ প্রকৃতির ধর্ম অমোঘ। ধার্মিক কিংবা ঈমানদার মুসলমান বলে প্রকৃতি তার নিজস্ব ধর্মের একচুল হেরফের ঘটাবেনা। আল্লাহ প্রকৃতির বিধি ব্যবস্থা এমনভাবে গঠন করে দিয়েছেন যে, হাত পা গুটিয়ে ঘরে বসে থাকলে প্রকৃতি নিজে এসে ধরা দিবেনা। প্রকৃতির বিরূপতাকে খোদা প্রদত্ত জ্ঞান বুদ্ধির পূর্ণাঙ্গ ব্যবহারের মাধ্যমে আয়ত্ব করে নিয়ে পৃথিবীকে নিজেদের বাসযোগ্য করে তুলতে হবে। প্রকৃতিকে কাজে লাগানোর জন্য অনুসন্ধান, গবেষণা ও ব্যবহার (Exploration, experimentation and exploitation) এর ব্যবস্থা করতে হবে। প্রকৃতি আস্তিক, নাস্তিক, ধার্মিক, অধার্মিক সবার প্রতি একইভাবে নিরপেক্ষ ও পক্ষপাতহীন। যে চাবে সে-ই পাবে। ‘ওয়া আল্লাইছা লিল ইঞ্ছানি ইল্লা মা ছা’আ – মানুষ যা চেষ্টা করে শুধু তাই পাবে।’ মুসলমানরা মোল্লাকী ধর্মের প্রভাবে যেদিন থেকে কোরআনের এই বাণীকে উপেক্ষা করতে শুরু করেছে সেদিন থেকেই তার অধঃপতনের সূত্রপাত॥

– মিজানুর রহমান / মোল্লা : দ্য মুসলিম বিভীষণ ॥ [ তিলোত্তমা – অক্টোবর, ১৯৯৭ । পৃ: ১৪৭-১৪৯ ]


শেয়ার করুন