আবার রোহিঙ্গা-ঢলের আশঙ্কা জাতিসংঘের

গত কয়েক দিনে রাখাইনে বড় ধরনের সহিংসতার খবর না থাকলেও রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসা থেমে নেই। ফাইল ছবি।

সিটিএন ডেস্ক:
রাখাইন থেকে প্রাণ বাঁচাতে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাংলাদেশে পালিয়ে আসা থামছে না। এই পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া রাজ্যটি থেকে বাংলাদেশে আরও বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার ঢল নামতে পারে বলে আশঙ্কা করছে জাতিসংঘ।

জাতিসংঘের মানবিক–বিষয়ক সমন্বয় দপ্তরের (ওসিএইচএ) আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল মার্ক লোকক বাংলাদেশ সফর শেষে জেনেভা ফিরে গতকাল শুক্রবার এই আশঙ্কার কথা জানান। গতকাল জেনেভায় আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) মুখপাত্র জোয়েল মিলম্যান আলাদা এক ব্রিফিংয়ে জানান, রাখাইন থেকে প্রতিদিন গড়ে দুই হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে।

গতকাল বিকেলে ইয়াঙ্গুন ও সিত্তের কূটনৈতিক সূত্রগুলোতে যোগাযোগ করে জানা গেছে, গত কয়েক দিনে রাখাইনে বড় ধরনের সহিংসতার খবর না থাকলেও রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে যাওয়া থেমে নেই। রাথেডংয়ের একটি গ্রামের প্রসঙ্গ টেনে একটি সূত্র প্রথম আলোকে জানিয়েছে, প্রায় দুই মাস ধরে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিকে (ডব্লিউএফপি) গ্রামটিতে খাবার সরবরাহ করতে দেওয়া হচ্ছে না। ফলে খাবারের সংকটে ওই লোকজনের বাংলাদেশে চলে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। এর পাশাপাশি নিরাপত্তাহীনতা, জীবিকার অভাবসহ বিভিন্ন কারণে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে চলে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে।

এদিকে রাখাইনে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য মিয়ানমারকে আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছে ভারত ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। গতকাল দিল্লিতে ভারত–ইইউ শীর্ষ সম্মেলন শেষে প্রচারিত যৌথ বিবৃতিতে এই আহ্বান জানানো হয়েছে। ওই আলোচনায় ইইউ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টাস্ক রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরিয়ে নিতে আবারও মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানান।

নতুন ঢলের আশঙ্কা

বার্তা সংস্থা রয়টার্স ও এএফপি জানায়, বাংলাদেশ সফরের অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে গিয়ে ওসিএইচএর আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল মার্ক লোকক রোহিঙ্গারা আবার বিপুল সংখ্যায় পালিয়ে আসার বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এই পরিস্থিতিতে তিনি পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার কথাও বলেছেন। জেনেভায় সংবাদ সম্মেলনে মার্ক লোকক বলেন, ‘এখনো মিয়ানমার থেকে লোকজনের আসা থামেনি। এখনো মিয়ানমারে কয়েক লাখ লোক আছেন। আরও ঢল নামতে পারে, এটা বিবেচনায় নিয়ে আমরা তৈরি থাকতে চাই। ৫ লাখ লোক লাঠি হাতে নিয়ে আর পাগলামি করে দেশ ছেড়ে পালায়নি।’

রাখাইনে জরুরি ত্রাণকর্মীদের এখনো কাজ করতে না দেওয়াকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ হিসেবে অভিহিত করেন জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা দপ্তরের প্রধান।

ভারত–ইইউ বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ

ভারতের সঙ্গে ইইউর শীর্ষ বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গটি এসেছে। এরপর আলোচনা শেষে যৌথ বিবৃতিতে এ বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে। তবে যৌথ বিবৃতিতে রাখাইনের সমস্যা নিয়ে কথা হলেও সেখানকার সংখ্যালঘু মুসলিমদের রোহিঙ্গা হিসেবে অভিহিত করা হয়নি। যদিও ডোনাল্ড টাস্ক তাঁর বক্তৃতায় রোহিঙ্গা শব্দটি একাধিকবার ব্যবহার করেছেন।

ইইউর প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘আমরা উত্তেজনার অবসান চাই এবং মিয়ানমার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাক। এ ছাড়া সেখানে জরুরি ত্রাণকর্মীদের মিয়ানমার কাজ করাটা নিশ্চিত করুক। রোহিঙ্গাদের অবশ্যই স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে মিয়ানমারে যাওয়া নিশ্চিত করতে হবে। সংকটের মূল কারণের সমাধানের জন্য আমরা রাখাইন পরামর্শক কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের আহ্বান জানাই।’ তাঁর মতে, প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের প্রথমেই এতে সাড়া দেওয়া উচিত।

রাখাইনে সহিংসতার কারণে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার বিষয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে ভারত ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। জঙ্গিগোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) কয়েক দফা হামলায় নিরাপত্তা বাহিনী ও বেসামরিক লোকজনের প্রাণহানিতে যে সহিংসতা উসকে দিয়েছে, তা দুই পক্ষ উল্লেখ করে। দুপক্ষই রাখাইনে সহিংসতা বন্ধ করে অবিলম্বে শান্তি ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি স্বীকার করেছে। তারা কফি আনানের নেতৃত্বাধীন রাখাইন পরামর্শক কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন এবং উত্তর রাখাইনের বাস্তুচ্যুত সব সম্প্রদায়ের লোকজনের ফেরার লক্ষ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানিয়েছে। ভারত ও ইইউ দুর্গত লোকজনের জন্য বাংলাদেশের মানবিক সহায়তার প্রশংসা করেন।

ডায়রিয়া ও কলেরা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা: ইউনিসেফ

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ডায়রিয়া ও কলেরা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছে জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ)। গতকাল শুক্রবার জেনেভার জাতিসংঘ দপ্তরে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে ইউনিসেফ এই আশঙ্কা প্রকাশ করে।

প্রেস ব্রিফিংয়ে ইউনিসেফের স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রধান মায়া ভ্যান্ডিনেন্ট বলেন, ‘আমরা যা দেখছি তা হলো মানুষজন সম্পূর্ণরূপে শক্তিহীন এবং শিশুরা রোগবালাইয়ের ঝুঁকিতে। সেখানে পানিবাহিত তীব্র ডায়রিয়া ও কলেরার বাস্তব ঝুঁকি আছে। আমরা খুবই উদ্বিগ্ন। সে কারণে স্বাস্থ্য খাতে আমরা সহায়তা বাড়াচ্ছি।’

ইউনিসেফের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ মাসেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে এক বছরের বেশি বয়সী শিশুদের কলেরার টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। ৭ অক্টোবর (আজ) মুখে খাওয়ার ৯ লাখ ডোজ কলেরার টিকা বাংলাদেশে পৌঁছাবে। ১০ অক্টোবর থেকে শিশুদের টিকা খাওয়ানো হবে।

ইউনিসেফ বলছে, গত ২৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশে ৫ লাখ ১৫ হাজার নতুন রোহিঙ্গা এসেছে। নতুনদের মধ্যে ৬০ শতাংশ শিশু। এদের ৩০ শতাংশের বয়স ৫ বছরের কম। গত সপ্তাহ পর্যন্ত ক্যাম্পগুলোতে ৫ হাজার ১১ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার তথ্য আছে।

ডায়রিয়া ও কলেরা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকে ইউনিসেফ তা প্রতিরোধ করার জন্য কর্মসূচি শুরু করেছে। তাদের উদ্যোগের সঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি), এমএসএফ এবং অন্য কিছু সংস্থা আছে। ইউনিসেফের ২ হাজার ৬২৫টি টিউবওয়েল, ১৫ হাজার ৭৫০টি ল্যাট্রিন স্থাপনের পরিকল্পনা আছে।

মায়া ভ্যান্ডিনেন্ট বলেন, ক্যাম্প বাড়ানোর পরিকল্পনা বৃহত্তর অর্থে অনুপস্থিত এবং সেখানে ভালো স্যানিটেশন, নিষ্কাশন ইত্যাদির অবকাঠামো নেই। বৃষ্টির পানি ল্যাট্রিনসহ ক্যাম্প ধুয়ে নিয়ে যায়। বর্তমানে ক্যাম্পগুলোতে জনঘনত্ব খুব বেশি। এসব কারণ রোগের প্রকোপ দেখা দেওয়ার ও রোগ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি করেছে।

আসিয়ানকে অ্যামনেস্টির চিঠি

মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংস্থার (আসিয়ান) নেতাদের দায়ী করেছে। লন্ডনভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠনটি গত শুক্রবার আসিয়ানের সভাপতির কাছে লেখা এক চিঠিতে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় জোটের নেতাদের জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে বলেছে।


শেয়ার করুন