আপাতত মন্ত্রিত্ব টিকে গেল আশরাফের

untitled-9_148439সমকাল:
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে, তিনি সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে আর মন্ত্রী রাখছেন না_ এমন একটি গুঞ্জনে গতকাল তোলপাড় হয়েছে সারাদেশ। তবে গুঞ্জন শেষ পর্যন্ত গুঞ্জনই থেকে গেছে। সৈয়দ আশরাফের মন্ত্রিত্ব আপাতত টিকে গেছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দীর্ঘদিন যাবৎ নানা কারণে এলজিআরডি মন্ত্রীর ওপর অসন্তুষ্ট, ক্ষুব্ধ। মন্ত্রণালয়ে নিয়মিত না যাওয়ার বদঅভ্যাস, মন্ত্রিসভার বৈঠকে যেতে অনাগ্রহ, দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কার্যত যোগাযোগ না রাখা, তার বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় জমে উঠেছিল। গতকাল মঙ্গলবার সকালে একনেকের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে তার ও প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গার অনুপস্থিতিতে দারুণভাবে ক্ষুব্ধ হন প্রধানমন্ত্রী। বৈঠকের আলোচ্য সূচিতে এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের ৬০৭৬ কোটি টাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প ছিল। অর্থমন্ত্রী মুহিত মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে প্রকল্পটি নিয়ে আলোচনা স্থগিত করতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী তাতে সম্মত না হয়ে বলেন, কাজের সুবিধার্থে মন্ত্রী ‘চেঞ্জ’ করব। প্রকল্প অনুমোদন হবেই। একনেক বৈঠকের এসব কথা দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে একাধিক টিভি চ্যানেল সত্যাসত্য যাচাই না করেই এই মর্মে ‘ব্রেকিং নিউজ’ প্রচার করে যে, সৈয়দ আশরাফুল মন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন।

সৈয়দ আশরাফের মন্ত্রিত্ব আছে কি নেই_ সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাব মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা বলেন, তাকে মন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়নি। মন্ত্রিসভায় রদবদলেরও কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।
একনেক বৈঠকে অংশ নিয়েছেন পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ড. শামসুল আলম। তিনি বিডিনিউজকে জানান, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন_ ‘উনি (সৈয়দ আশরাফ) মিটিং-টিটিংয়ে আসেন না। এ জন্য সরিয়ে দিলে ভালো হয়।’ বৈঠকে অংশ নিয়েছেন এমন একাধিক মন্ত্রী বলেছেন, সৈয়দ আশরাফকে সরিয়ে এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদকে নিতে বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তোফায়েল আহমেদ এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে দেওয়ার প্রস্তাব দেন। একনেক বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার কক্ষে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলেন।
একনেক বৈঠকে উপস্থিত না থাকার কারণ জিজ্ঞাসা করলে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গা সমকালকে বলেছেন, তিনি রাষ্ট্রীয় সফরে ফ্রান্স ও জেনেভায় গিয়েছিলেন। গতকাল দুপুরে দেশে ফিরেছেন। একনেক বৈঠকের বিষয়ে কিছুই জানতেন না। এ ব্যাপারে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে তাকে কোনো চিঠি দেওয়া হয়নি।

গুঞ্জন :একনেক বৈঠকের পর সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে এলজিআরডি মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেওয়ার গুঞ্জনের বিষয়টি তার সহকর্মীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময় সংসদের অধিবেশন চলছিল।
সৈয়দ আশরাফ গতকালও সংসদে ছিলেন না। প্রধানমন্ত্রী তাকে টেলিফোনে সংসদ ভবনে ডেকে পাঠান। প্রধানমন্ত্রী বেশ কিছু সময় তার সঙ্গে একান্তে কথা বলেন।
এদিকে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার পর সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম তার সরকারি বাসভবন হয়ে কিশোরগঞ্জের উদ্দেশে রওনা হন। তিনি স্থানীয় সমবায় কমিউনিটি সেন্টারে জেলা আওয়ামী লীগের ইফতার পার্টিতে অংশ নেন।
আওয়ামী লীগের কয়েকজন নীতিনির্ধারক নেতা মন্ত্রিসভায় আকস্মিক পরিবর্তনের গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়লে বিস্মিত হন।

পেছন ফিরে দেখা :অভিযোগ রয়েছে, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম অনেক সময় প্রধানমন্ত্রীর টেলিফোনও রিসিভ করেন না। বর্তমান সরকারের প্রায় দেড় বছরে হাতেগোনা কয়েক দিন অফিস করেছেন। সংসদ অধিবেশনেও যোগ দিয়েছেন কালেভদ্রে। গত ৯ জুন সংসদের চলতি অধিবেশনে ২০১৪-১৫ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেটের ছাঁটাই প্রস্তাবে স্বীয় মন্ত্রণালয়ের চাহিদা চাওয়ার সময়ও অনুপস্থিত ছিলেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তার অনুপস্থিতিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম। মঞ্জুরি দাবির ওপর ছাঁটাই প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে ময়মনসিংহ-৮ আসনের সদস্য ফখরুল ইমাম বলেন, মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সংসদে নেই। তাকে সংসদে কমই দেখা যায়। তাকে সংসদে দেখি কম, তার সঙ্গে চেনা-জানা কম। এই মন্ত্রীর বাসায় গিয়ে প্রায়ই ফাইল অনুমোদনের জন্য পদস্থ কর্মকর্তাদের ধরনা দিতে হয়। ফলে মন্ত্রীর অফিস ও সরকারি বাসায় ফাইলের স্তূপ জমে থাকে।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অভিযোগ, তিনি সরকারি দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হলেও পারতপক্ষে দলীয় কার্যালয়মুখো হন না। নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই বললেই চলে। এ নিয়ে সহযোগী সংগঠনের নেতারা আনুষ্ঠানিক বৈঠকে তার কড়া সমালোচনা করেছেন। সৈয়দ আশরাফ নির্বাচনী এলাকায় কমই যান।

এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের পদস্থ কর্মকর্তারা সমকালকে জানিয়েছেন, গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের একজন মন্ত্রী হওয়ার পরও সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম মন্ত্রণালয়ের মাসিক বৈঠকে প্রায়ই অনুপস্থিত থাকছেন। এ কারণে তার বেইলি রোডের সরকারি বাসায় গুরুত্বপূর্ণ ফাইল অনুমোদনের জন্য নিয়ে যান সচিবসহ পদস্থ কর্মকর্তারা। তারপরও ফাইলে স্বাক্ষর করতে আগ্রহ কমই দেখান মন্ত্রী। তিনি পারতপক্ষে এক সপ্তাহের আগে কোনো ফাইলের অনুমোদন দেন না। মন্ত্রীর নিয়মিত অনুপস্থিতি ও দাপ্তরিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় সঠিক নির্দেশনা না থাকায় কর্মকর্তারা অনেক সময় জরুরি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। তারা অনেক সময় মন্ত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করেও ব্যর্থ হন।
মন্ত্রীর প্রায় নিয়মিত অনুপস্থিতি ও দিকনির্দেশনার অভাবে চলতি অর্থবছরে এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের বেশ কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্প সঠিক সময়ে বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি আদৌ নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন হবে কি-না তা নিয়েও রয়েছে সন্দেহ।

কিশোরগঞ্জ অফিস জানায়, এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম গতকাল সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের পূর্বনির্ধারিত ইফতার মাহফিলে যোগ দিতে কিশোরগঞ্জে আসেন। ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জ আসার সময় বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের স্ক্রলে দেখানো হয়_ মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তার স্থলে প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। এমন সংবাদ প্রচারিত হলে কিশোরগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ব্যাপক কৌতূহলের সৃষ্টি হয়। মানুষ ইফতার মাহফিলের স্থান ‘কিশোরগঞ্জ সমবায় কমিউনিটি সেন্টারে’ মন্ত্রীকে দেখতে ভিড় করেন। বিভিন্ন মিডিয়ার অর্ধশত সাংবাদিক অনুষ্ঠানস্থলে চলে আসেন। ইফতারের ১৫ মিনিট আগে মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সেখানে উপস্থিত হন। তাকে মন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে কি-না সাংবাদিকরা জানতে চাইলে তার সংক্ষিপ্ত জবাব_ গুজবে কান দেবেন না। তার ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহকর্মী জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক এম এ আফজল সমকালকে বলেন, একান্তে মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে তার এ বিষয়ে কথা হয়েছে। সৈয়দ আশরাফ বলেছেন, ঘটনাটি সত্য নয়। আজ বুধবার তার নির্বাচনী এলাকা জেলার হোসেনপুর উপজেলায় আওয়ামী লীগ আয়োজিত ইফতার মাহফিলে মন্ত্রীর অংশগ্রহণের কথা রয়েছে।


শেয়ার করুন