ভাষা ও স্বাধীনতা সংগ্রামী

আপসহীন সংগ্রামী ও বরেণ্য শিক্ষাবিদ মোহাম্মদ রমিজ

Kalam Azad

Kalam Azad

কালাম আজাদ :

বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে জাতীয় প্রেক্ষাপটকে ঘিরে এবং কক্সবাজার এবং কুতুবদিয়া অঞ্চলে যত ধরনের রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে সবকটি আন্দোলনের এক নিবেদিত প্রাণের নাম মোহাম্মদ রমিজ। কুতুবদিয়া উপজেলার দক্ষিণ ধুরং ইউনিয়নের ধুরং এলাকার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের জন্ম গ্রহণ করেন তিনি। বাবা ইউসুফ আলী সিকদার ছিলেন কুতুবদিয়া উপজেলার দশজন জমিদারের একজন। তিনি একাধারে শিক্ষাবিদ, শিক্ষাবিস্তারের অগ্রনায়ক, ক্রীড়াবিদ, রাজনীতিবিদ, মানবাধিকারকর্মী, যোগ্য প্রশাসক এবং একনিষ্ঠ সমাজকর্মী। অতগুলো গুণের অধিকারী মোহাম্মদ রমিজ ১৯৫২ সালে কুতুবদিয়া উপজেলার ধুরুং উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ধুরুং উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যাট্ট্রিক পরীক্ষার্থী থাকাকালে বাংলার আকাশে প্রবাহিত হয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের হাওয়া। এই আন্দোলনে ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইতিহাসবিদ রশিদ আহমদ এর সহায়তায় শতাধিক শিক্ষার্থীর নেতৃত্বও দিয়েছেন ভাষার দাবির মিছিল ও সমাবেশে।

মনন ও মননে পরিপূর্ণভাবে বাঙালি জাতীয়বাদী বিশ্বাসী বলে ভাষা আন্দোলনের পক্ষে কাজ করতে গিয়ে ১৯৫৩ সালের শহীদ দিবস পালনকালে এবং বাঙালি জাতীয়তার প্রচার করায় ১৯৫৬ সালে জীবনে দুই বার পাকিস্তান পুলিশ কর্তৃক আটক হন। ম্যাট্রিক পাশ করে ভর্তি হন চট্টগ্রাম কলেজ (ওই সময় কক্সবাজার জেলায় কোনো কলেজ ছিলো না বলেই বাধ্য হয়ে চট্টগ্রামের কোনো কলেজে ভর্তি হতে হতো কক্সবাজার অঞ্চলের শিক্ষার্র্থীদেরকে)। ওই কলেজে পড়াকালীন সময়ে অনুষ্ঠিত হয় ’৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট আন্দোলন। পাকিস্তান বিরোধী প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ওই কলেজে অধ্যয়নকালে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ফ্রন্টের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করায় এবং স্থানীয় ও বংশগত প্রবল বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়েছে।

চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ১৯৫৫ সালে  আই এ পাশ করে ভর্তি হন  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৫৬-১৯৫৭ এবং ১৯৫৭-১৯৫৮ শিক্ষাবর্ষে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে (বর্তমানে সার্জেন্ট জহরুল হক হল) পর পর দু’বার এথলেটিক্স সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। এবং এ দু’বারই চ্যাম্পিয়নশীপন লাভ করেন। ক্যারম ও টেবিল টেনিসেও তিনি ছিলেন হল চ্যাম্পিয়ন। কুতুবদিয়ায়ও বেশ কয়েকবার ক্যারামে চ্যাম্পিয়ন লাভ করেন। 

১৯৫৯ সালে ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি এ (সম্মান) ডিগ্রী অর্জন করে যে ধুরুং উচ্চ বিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন সে উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ধ্বংস প্রায় ধুরং উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগদান করে নিজের শ্রম, মেধাকে কাজে লাগিয়ে সকল ঘাত-প্রতিঘাত, লাঞ্চনা, অপমান, আর্থিক সংকট মোকাবেলা করে তিলে তিলে ওই বিদ্যালয়কে গড়ে তুলেছে  যা কিনা-বর্তমানে কক্সবাজার জেলার একটি অনন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। মাসিক ৩০/৪০ টাকা শিক্ষক বেতন, যে স্কুলে বকেয়া থাকতো মাসের পর মাস সেখানে খাল ভরাট করে স্কুল মার্কেট তৈরি করে আর্থিক সংকটের সমাধান করেছেন সংগ্রামী  মোহাম্মদ রমিজ। শিক্ষকদের জন্য রয়েছে প্রাইভেট ফাণ্ড ও বেনোভোলেন্ট ফাণ্ড। আর এসব কিছুর পেছনের রয়েছে আজীবন সংগ্রামী ও শিক্ষাবিদ মোহাম্মদ রমিজের শ্রম ও মেধা। শুধু তাই নয়, নিজে একজন ক্রীড়াবিদ বিধায় ধুরং স্টেডিয়াম নির্মাণে মূখ্য ভূমিকা পালন করেন তিনি ।

ওই বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক থাকাকালে ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ ডিগ্রীও অর্জন করে নেন তিনি। পাশাপাশি ঢাকা শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ থেকে উচ্চতর ২য় বিভাগে বি.এড ডিগ্রী অর্জন করেন।

মাস্টার মোহাম্মদ রমিজ

মাস্টার মোহাম্মদ রমিজ

শিক্ষকতার পাশাপাশি বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী বলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একজন সহচর হিসেবে ১৯৬৪ সালের কপ আন্দোলন, ৬ দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর অভ্যুত্থান ও ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হিসেবে দেশকে পাকিস্তান থেকে মুক্ত করার কাজে নিজে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং পাশাপাশি শিক্ষার্থী ও এলাকার কৃষক শ্রমিক জনতাকেও ঝাঁপিয়ে আহ্বান জানিয়েছেন।

১৯৭০ সালে পাকিস্তানের শেষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জহিরুল ইসলামের পক্ষে কাজ করায় স্থানীয় ও বংশগতভাবে প্রবল বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনের পক্ষে কাজ করেন এবং ধুরং উচ্চ বিদ্যালয়ে পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।

৭ মার্চের পর কুতুবদিয়া থানা সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হলে ওই কমিটির অন্যতম সদস্য হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেন। ২৫ মার্চ পাকিস্তান হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ঝাঁপিয়ে পড়েন।

২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকে মে পর্যন্ত কুতুবদিয়ায় মুক্তিযুদ্ধে প্রস্তুতি, বিভিন্ন অপারেশন, মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং, কালুরঘাট যুদ্ধে অংশগ্রহণ ও যুদ্ধ সামগ্রী প্রদান, পাকিস্তানি জাতীয় পতাকা পুড়িয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন, সশস্ত্র প্রতিরোধে নেতৃত্বদানকারী এবং অংশগ্রহণকারীর বিরুদ্ধে এমএলআর পাকিস্তান দন্ডবিধি ১২৮(ক) ধারার ১৪ নং সামরিক আইন বিরোধী/ সৈন্যদের চলাচলে বাঁধা প্রদান, ভবণ ও কালভার্টের ধ্বংস কার্যে সক্রিয় এবং রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতা অভিযোগে সামরিক আইনবিধির ১৬ (ক) ধারায় সারাদেশের ন্যায় কক্সবাজার মহকুমার কুতুবদিয়াথানায় রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দায়ের করে পাক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত পূর্ব পাকিস্তান সরকার। ওই রাাষ্ট্রদ্রোহী মামলায় ধুরং হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ রমিজকে ২০ নং আসামী করা হয়। ওই মামলার ১ নং আসামী ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা নুরুচ্চফা বিকম। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অবর্ণনীয় দুঃখ দুদর্শার সম্মুখীন হতে হয়েছে।

স্বাধীনতার পরে থানা এডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিললের চেয়ারম্যান, ফ্যাক্টস ফাউন্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান, শালিশী বোর্ডের সদস্য, খাসজমি বন্দোবস্ত এবং বাছাই কমিটির সদস্য ও পঞ্চায়েত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরশাদ শাসনামলে ঋণ শালিসী বোর্ডের সদস্য, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১৯৯৯ সালে তিনি অর্পিত সম্পত্তি বাছাই কমিটির দায়িত্ব পালন করেন। তাছাড়া তিনিকৃষিঋণ, মনিটরিং সেল, থানা সমাজ সেবা কমিটি, কক্সবাজার জেলা প্রাথমিক শিক্ষক কমিটির সহসভাপতি ও থানা কমিটির সভাপতি, পাঠকের মজলিস, ধুরং লেমশীখালি ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন, ধুরং ইয়ং ক্লাব এর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা কুতুবদিয়া থানার প্রধান পৃষ্টপোষক হিসেবে মানবতার পক্ষে কাজ করেছিলেন।পেশা শিক্ষক হলেও নেশা কিন্তু শিক্ষা বিস্তারের অগ্রণী নায়ক। সে লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে কুতুবদিয়া নৈশ কলেজ (বর্তমানে কুতুবদিয়া ড্রিগী কলেজ) প্রতিষ্ঠায় তিনি উল্লেখ্যযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। আলী আকবর ডেইল উচ্চ বিদ্যালয়, সতরউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়, উত্তরণ বিদ্যানিকেতন, লেমশীখাীল উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় পরোক্ষভাবে শিক্ষা বিস্তারের অগ্রনায়ক মোহাম্মদ রমিজ এর সহযোগিতায় অনস্বীকার্য।

তাছাড়া টেকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তেইল্যাকাটা প্রাথমিক বিদ্যালয়, ডিংগাভাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রভৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারি অনুমোদনের ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।


শেয়ার করুন