আন্তর্জাতিক ইসলামী মহাসম্মেলন : ইতিহাস ও লক্ষ্য উদ্দেশ্য

img_20170218_003828মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :

আশির দশকের কথা। ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনের অগ্রসৈসিক, আওলাদে রাসূল (সঃ) শায়খুল ইসলাম হজরত সায়্যিদ হোসাইন আহমদ মাদানী (রহ.) এর সুযোগ্য উত্তরসুরী ও তারাই স্নেহধন্য সন্তান ফিদায়ে মিল্লাত সায়্যিদ আসআদ মাদানী (রহ.) দ্বীনি ফিকির নিয়ে বাংলাদেশ সহ উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশ নিয়মিত সফর করেতেন। তিনি বাংলাদেশ সফরে এসে শহর, গ্রামগঞ্জে বিভিন্ন দ্বীনি সমাবেশ, ইজতিমা ও ওয়াজ মাহফিলে যোগ দিতেন। ফিদায়ে মিল্লাত (রহ.) দ্বীনি মাহফিল করতে গিয়ে উপলদ্ধি করলেন, বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জের তুলনায় শহর এলাকায় দ্বীনের দাওয়াত ও বিভিন্ন কার্যক্রম অপেক্ষাকৃত কম হচ্ছে। এই উপলদ্ধি থেকে হজরত আসআদ মাদানী (রহ.) বাংলাদেশের বড় বড় শহরগুলোতে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে, ব্যাপক পরিসরে বৃহৎ দ্বীনি মাহফিল করার চিন্তা করলেন। যে মাহফিলের মূল লক্ষ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে- দ্বীনের দাওয়াত, ইসলামের সঠিক আদর্শের প্রচার, হক্কানিয়তের সঠিক ধারনা ছড়িয়ে দেওয়া, মানবতার মুক্তির উদ্দেশ্য সর্বস্তরের মানুষকে সিরাতে মুস্তাকীমের দিকে আহবান করা, সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ইসলামের সহীহ আক্বীদার বিশ্বাস স্থাপন করা ও মানুষের হৃদয়ে মহানবী ও শেষ নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি করা। পাশাপাশি শিরক, কুফর ও বিদআত, বাতিল চিন্তাধারা ও ভ্রান্তনীতির বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টি করা। এই মহান লক্ষ্য উদ্দেশ্যকে টার্গেট করে ফিদায়ে মিল্লাত (রহ.) শীর্ষ ওলামা মশায়েখ ও হক্কানী পীর বুজর্গদের সুতিকাগার হিসাবে খ্যাত চট্টগ্রামে ১৯৮৫ সালের শেষ দিকে আলেম ওলামাদের এক বৈঠক ডাকলেন। সেই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুয়ায়ী ১৯৮৬ সালের প্রথমদিকে চট্টগ্রাম সাকির্ট হাউস ময়দানে সর্বপ্রথম দুইদিন ব্যাপী “আন্তজার্তিক ইসলামী মহাসম্মেলন” অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে বহু বিশ্ববরণ্য ওলামা মশায়েখ, আওলাদে রাসূল (স:), বুজর্গ, ইসলামী পান্ডিতগণ অংশ নেন। এভাবেই আন্তজার্তিক ইসলামী মহাসম্মেলনের গোড়াপত্তন হয়। ১৯৮৬ সালে থেকে পর পর চার বছর চট্টগ্রাম সাকির্ট হাউস মায়দানে এই মহাসম্মেলন অনুষ্ঠানের পর ৫ম বছর থেকে এই বছর পর্যন্ত চট্টগ্রাম জামিয়াতুল ফালাহ্ ময়দানে এই মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই সম্মেলন কমিটির প্রথম ও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন আল-জামিয়া আল- ইসলামিয়া পটিয়ার তৎকালনী মহাপরিচালক হজরত মওলানা হাজী মুহম্মদ ইউনুস (রহ.), সেক্রেটারী ছিলেন বতর্মান মহাপরিচালক হজরত মওলানা আবদুল হালীম বোখারী সাহেব, একই প্রতিষ্ঠানের তৎকালীন সহকারী মুহতামিম ফকিহুল মিল্লাত মুফতী আব্দুর রহমান (রহ.) ছিলেন একই কমিটির ব্যবস্থাপক। পরে “ইসলামী সম্মেলন সংস্থা বাংলাদেশ” নামকরণ করে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে ৯০৬১ নম্বর রেজিষ্ট্রেশন নেয়া হয়। এই সম্মেলন সংস্থার উদ্যোগে চট্টগ্রাম, ঢাকা, কক্সবাজার, সিলেট, নোয়াখালী ফেনী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, দিনাজপুর, বংপুর, কুমিল্লা, বি-বাড়িয়া, সহ দেশের বড় শহর গুলোতে প্রতিবছর সফলভাবে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। পরবর্তীতে জামিয়া পটিয়ার মহপরিচালক আল্লামা হারুণ ইসলামাবাদী (রহ.) ও হাটহাজারী দারুল উলুম মঙ্গনুল ইসলাম বড় মাদ্রাসার মুহতামিম হজরত আল্লামা আহমদ শফি (রহ.) সভাপতি দায়িত্ব পালন করেছেন এবং ফকিহুল মিল্লাত মুখতি আব্দুর রহমান (রহ.) কিছুদিন সেক্রেটারি দায়িত্ব ও পরে আমৃত্যু সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে জামিয়া পটিয়ার মহাপরিচালক আল্লামা মুফতি আব্দুল হালিম বোখারী (রহ.) সভাপতি ও ঢাকাস্থ বসুন্ধরা ইসলামী সেন্টারের মহাপরিচালক ফকিহুল মিল্লাত (রহ.) এর জাঁনশীন মুফতী হজরত আরশাদ রহমানী সেক্রেটারী হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।
দ্বীন প্রচারের এই মহৎ ও বিশাল কার্যক্রম স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তা, দেওবন্দীয়তের আর্দশকে ধারন করেই সুদীর্ঘ ৩২ বছর ধরে এ মহাসম্মেলন চলছে। কওমী মাদ্রাসা ও দ্বীনিশিক্ষার বিরুদ্ধে সব ষড়যন্ত্রের গঠনমূলক ও ইতিবাচক জবাব দেয়া হচ্ছে এই সম্মেলন থেকেই। যেকোন প্রকারের বিদআত গোনাহ ও মাকরুহ কাজ যাতে এই সম্মেলনে নাহয়, সেদিকে কঠোর নজর রাখা হয়। যেমন-ভিডিও, ছবি উঠানো থেকে বিরত থাকা। সম্মেলনের রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণ বক্তব্য না দেয়া। বাণিজ্যিক ও অতি পেশাদার, অপ্রয়োজনীয় কথা বলেন, এমন বক্তাকে সম্মেলনে দাওয়াত না দেয়া। অতিরিক্ত আলোকসজ্জা থেকে বিরত থাকা, উচ্চতর পদবী ধারী ও ক্ষমতাধরকে দাওয়াত না দেয়া, যার কারণে আমন্ত্রিত ওলামা মশায়েখগণ বিভ্রত হবেন এবং তাদের মান মর্যাদা ক্ষুণœ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ঈমান, আক্বীদা, তাহযীব-তমাদ্দুন বিধ্বংসী, ফেতনা সৃষ্টিকারীদের চক্রান্তে জাল ছিন্ন করে মানুষের অন্তরে সত্যিকারের তাওহীদে খালেস, হুবেব রাসূল ও ইত্তিবায় সুন্নতের জাগরণ সৃষ্টি করেছে এই মহাসম্মেলন।
কক্সবাজারের প্রথম ইসলামী সম্মেলনটি ১৯৮৫ সালে কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ আদালতের প্রথম পিপি এড. ফিরোজ আহামদ চৌধুরী ও ধাওনখালী মাদ্রাসার মুহতামিম মওলানা মুহাম্মদ মুসলিমের নেতৃত্বে শহরের পাবলিক লাইব্রেরী ময়দানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। পরে ১৯৮৬ সাল থেকে ইসলামী সম্মেলন সংস্থার অধীনে কক্সবাজারের আন্তর্জাতিক ইসলামী মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এ সম্মেলনে আওলাদে রাসূল (স:) হযরত শাহ আবদুল মজীদ নদীম (রহ.), বিশ্বখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসায় মুহতামিম মুখতি আবুল কাসেম নুমানী, বায়তুল মোকদ্দসের খতিব সহ বিশ্ববরেণ্য ইসলামী চিন্তাবীদ ও যুগশ্রেষ্ঠ আলেম ওলামাগণ অংশ নিয়েছেন। বর্তমানে ইসলামী সম্মেলন সংস্থা কক্সবাজার শাখা সভাপতি হচ্ছেন-পোকখালী বড় মাদ্রাসার মুহতামিম মওলানা মোক্তার আহমদ, নির্বাহী সভাপতি হচ্ছেন-ধাওনখালী মাদ্রাসার মুহতামিম মুহাম্মদ মুসলিম ও রাজারকুল আজিজুল মাদ্রাসার পরিচালক মওলানা মুহাম্মদ মোহছেন শরীফ সেক্রেটারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ কমিটির উদ্যোগেই আজ ১৮ ফেব্র“য়ারি ও আগামীকাল ১৯ ফেব্র“য়ারি কক্সবাজার কেন্দ্রীয় ঈদগাহ ময়দানে আন্তর্জাতিক ইসলামী মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ফেতনা সৃষ্টিকারী, বাতিলপন্থী, ইসলামের অপব্যাখ্যাকারীদের চরম হুমকির মুখে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আকাবিরগণ ধারাবাহিক ও সফলভাবে এই মহাসম্মেলন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব পালন করেছেন। আকাবিরগনের রেখে যাওয়া এই আমানত বর্তমানে দায়িত্বশীলেরাও সফল ও সুন্দরভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবেন এই প্রত্যাশায় থাকল।
লেখক ঃ এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, ঢাকা।


শেয়ার করুন