আজ বিশ্ব সমুদ্র দিবসঃ সমুদ্র দূষণে  অক্সিজেন সংকট, বাড়ছে 

সিটিএন ডেস্কঃ

করোনার বদৌলতে বছরজুড়ে অক্সিজেন সংকট দেখছে বিশ্ব। কোটি টাকার সম্পদও রক্ষা করতে পারেনি প্রাণ। কোথাও কোথাও টাকা দিয়েও মেলেনি একটু অক্সিজেন। কিন্তু প্রকৃতি যে প্রতিদিন অর্থ ছাড়াই অক্সিজেনের যোগান দিয়ে যাচ্ছে তার হিসেব করেছে ক’জন?

গবেষকরা বলছেন, প্রতিদিন একজন মানুষ ৫০০ থেকে দুই হাজার লিটার পর্যন্ত প্রাকৃতিক অক্সিজেন গ্রহণ করেন। যদিও অনেকেই জানেন না এই অক্সিজেনের উৎস কী? সাধারণত মানুষ জানে, স্থলভাগের গাছ থেকেই আসে অক্সিজেন।

কিন্তু ন্যাশনাল জিওগ্রাফি’র গবেষকরা বলছেন, পৃথিবীর মোট অক্সিজেনের প্রায় ৭০ শতাংশের যোগান দিচ্ছে সমুদ্র; যা উৎপাদন হচ্ছে ফাইটোপ্ল্যাংটনসহ সমুদ্রতলে জন্ম নেওয়া নানান উদ্ভিদ থেকে। তবে আশঙ্কাজনক তথ্যও দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে মাদ্রিদে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) জানিয়েছে, ১৯৬০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ৫০ বছরে সাগর-মহাসাগরের পানি গড়ে ২ শতাংশ অক্সিজেন হারিয়েছে বলে তাঁদের গবেষণায় উঠে এসেছে। গ্রীষ্মমণ্ডলের কোনো কোনো জায়গায় অক্সিজেন হারানোর এই হার ৪০ শতাংশ পর্যন্ত রেকর্ড করা হয়েছে। ষাটের দশকে বিশ্বের সমুদ্রগুলোর মাত্র ৪৫টি জায়গায় অক্সিজেনের মাত্রা কম ছিলো। ২০১০ সালে এসে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭০০-তে।

এই পরিস্থিতির জন্য উপকূলবর্তী কারখানা, কৃষি জমিতে রাসায়নিকের ব্যবহার ও প্লাস্টিক দূষণকে দায়ী করেন বিজ্ঞানীরা।

এদিকে, সম্প্রতি এক গবেষণা থেকে পরিবেশবাদী সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশান (এসডো) জানিয়েছে, ২০২০ সালের ২৬ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত দেশে শুধু পলিথিন বর্জ্য উৎপাদন হয়েছে ৭৮ হাজার টন। যা শেষ পর্যন্ত সমুদ্রে যাবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন গবেষকরা।

এই বিষয়ে এসডো’র মহাসচিব ড. শাহরিয়ার হোসেন বাংলাভিশন ডিজিটালকে বলেন, প্রকৃতি থেকে আমরা যে অক্সিজেন গ্রহণ করি তার ৭০ ভাগের বেশি আসে সাগর বা মহাসাগর থেকে। সাগরে বসবাস করে প্রায় ৩ লাখেরও বেশি উদ্ভিদ ও প্রাণী এরাই মূলত অক্সিজেন তৈরি করে। অথচ আমরা কেউই এটা ভেবে দেখি না যে, অক্সিজেন তৈরির কারিগরগুলো বাঁচতে না পারলে আমরা অক্সিজেন পাবো কোথায় আর বাঁচবোই বা কীভাবে?

তিনি বলেন, আ0মরা প্রতিনিয়ত সমুদ্রের দিকে রাসায়নিক দ্রব্য ঠেলে দিচ্ছি। প্রতিদিন প্রায় ৮০ লাখ ছোট বড় প্লাস্টিক বর্জ্য যাচ্ছে সমুদ্রে। আমরা গবেষণায় দেখেছি, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর প্রায় ১ লাখ টন বর্জ্য সমুদ্রে যাচ্ছে। সম্প্রতি এসডো’র সমীক্ষায় বেরিয়ে এসেছে করোনার বছরে বাংলাদেশে পলিথিন বর্জ্য উৎপাদন হয়েছে ৭৮ হাজার টন। এখনই সচেতন না হলে দুর্যোগ আরও ভয়াবহ হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও সুনীল অর্থনীতি বিকাশ নিয়ে কাজ করা সমুদ্র বিষয়ক দেশীয় সংগঠন সেভ আওয়ার সি’র পরিচালক ও মেরিন আন্ডারওয়াটার এক্সপ্লোরার এস এম আতিকুর রহমান বলেন, পৃথিবীর মাত্র ২৭ ভাগ স্থল আর বাকিটা সমুদ্র বা জলাভূমি। আমাদের সমাজে একটা কথা প্রচলন আছে- গাছ আমাদের অক্সিজেন দেয়। সবাই মনে করে, উপরের গাছই সব অক্সিজেন দেয়। পৃথিবীতে অক্সিজেনের ২০-৩০ ভাগ দেয় স্থলভাগের গাছ। আর বাকি ৭০ শতাংশই আসে সমুদ্র থেকে। এগুলো উৎপাদন করে সমুদ্রের নিচের কোরাল, সিউইড, প্ল্যাংটন, স্পঞ্জমোলাস্কসহ এই ধরনের অনেক উপাদান। মাইক্রো ফাইটোপ্ল্যাংটন সবচেয়ে বেশি কার্বন চুষে নিয়ে প্রচুর অক্সিজেন সরবরাহ করে।

তিনি আরও বলেন, কিন্তু সমুদ্র দূষণের কারণে এই প্রক্রিয়াটি নষ্ট হয়। অদৃশ্য কেমিকেল, ব্যবহৃত তেল তো অদৃশ্যভাবে সমুদ্রের ক্ষতি করছেই, তাছাড়া দৃশ্যমানও অনেকগুলো কারণে সমুদ্র দূষণ হচ্ছে। এর মধ্যে মাস ট্যুরিজম, জাহাজের দূষণ ও সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিকের মাধ্যমে সমুদ্র দূষণ হচ্ছে। উপকূলের ম্যানগ্রোভে গেলে এসব চিত্র খালি চোখে দৃশ্যমান। এসব দূষণ সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে ফাইটোপ্ল্যাংটনগুলোর। এতে অক্সিজেন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। যার ক্ষতিতে আমরাই বেশি পড়ছি। দুর্যোগও বাড়াচ্ছে এসব ঘটনা।

শিগগিরই এসব দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে সমুদ্র নির্ভর বায়ুস্তর, প্রতিবেশ ব্যবস্থা ও সমুদ্রকে ঘিরে থাকা অর্থনৈতিক সম্ভাবনাগুলোও নষ্ট হবে বলে জানান তিনি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি ও ইউনেস্কো’র আন্তসরকারীয় সামুদ্রিক সংস্থার ভারতীয় মহাসাগর বিষয়ক কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ড. মোসলেম উদ্দিন বলেন, সমুদ্রের সংগে আমাদের জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পৃথিবীর যেখানেই থাকি না কেন, সমুদ্রের ওপর আমাদের নির্ভর হতেই হবে। আমাদের জীবন ধারণের সবচেয়ে বড় উপাদান অক্সিজেন। বিজ্ঞানীরা গবেষণায় দেখেছেন, এই অক্সিজেনের অন্তত ৫০ ভাগ আসে শুধু সমুদ্রের উপরিভাগে থাকা ছোট ছোট ফাইটেপ্ল্যাংটনের মাধ্যমে। এছাড়া সিইউইড, সিগ্রাস, ম্যানগ্রোভ সবমিলিয়ে ৭০ শতাংশ অক্সিজেন আসে সমুদ্র বা সমুদ্র সংশ্লিষ্ট উপাদান থেকে। আমাদের ওষুধেরও বড় উৎস সামুদ্রিক বিভিন্ন প্রাণীসহ নানান উপাদান। অনেকে মনে করেন, শুধু মাছ বা সরাসরি কিছু খাদ্য সমুদ্র থেকে আসে। অথচ খাদ্যের আরও অন্যান্য অনেক উপাদান আসে সমুদ্র থেকে।

তিনি আরও বলেন, কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও ক্লাইমেট আমাদের কাছে বড় ইস্যু। এই কার্বন-ডাই-অক্সাইডের অন্তত ৯০ ভাগ বহন করে সমুদ্র। আমাদের বৃষ্টিপাত ও কৃষির পুরোটিই নিয়ন্ত্রণ করছে সমুদ্র। পৃথিবীর গতি প্রকৃতিও সমুদ্রের ওপর নির্ভর করেই তৈরি হয়েছে। সমুদ্র আমাদের অর্থনীতির অনেকটাই দিচ্ছে। আগামীর অর্থনীতিকে ভাবা হচ্ছে সমুদ্রের ওপর নির্ভর করেই। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো ৯০ ভাগ সামুদ্রিক প্রিডিয়েটর ইতোমধ্যে হারিয়ে গেছে। প্রবালের ৩ ভাগের প্রায় ১ ভাগ ইতোমধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে। কারণ একটাই- দূষণ।

আমাদের সার, বিষ, প্লাস্টিক, বর্জ্য সবকিছু এই সমুদ্রে যাচ্ছে। পৃথিবীর ডাম্পিং স্টেশনে রূপ নিচ্ছে সাগর। এতে সমুদ্রের অক্সিজেন কমছে ভয়াবহভাবে। বাড়ছে কার্বনডাই অক্সাইড। তাই এখন নিজেদের স্বার্থেই আমাদের সমুদ্রকে রক্ষা করতে হবে বলেও জানান এই সমুদ্র।


শেয়ার করুন