আজ বিশ্ব মা দিবস

219840_180

আজ বিশ্ব মা দিবস। সারা বিশ্বে বেশ ঘটা করেই দিনটি মাকে উৎসর্গ করেছে শত কোটি মানুষ। কিন্তু মানিকগঞ্জের হাজারো মা জানে না ‘মা দিবস’ বলে কোনো দিবস আছে। তবে সন্তানের প্রতি তাদের বিন্দুমাত্র ভালোবাসার কমতি নেই। বড় হয়ে সন্তানরা কর্মব্যস্ততার মাঝে মাকে ভুলে থাকলেও, মা ভুলেন না কখনো। এমনি কয়েকজন মায়ের জীবন চিত্র তুলে ধরা হলো, যে মায়েদের সন্তান থাকতেও মা ডাক শোনা হয় না। সামর্থবান সন্তান থাকতেও যে মায়েদের জীবন চলে কঠোর কায়িক শ্রম আর অন্যের দয়ায়।

জেলার দৌলতপুরের চর এলাকার এলাকার প্রবীণ লালতারা বেওয়ার বয়স ষাট পেরিয়ে গেছে। জেলা শহরের এক বাড়িতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন দীর্ঘ দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে। কোলে শিশু ছেলে আর পাঁচ বছর বয়সী এক মেয়ে রেখে তার স্বামী নিরুদ্দেশ হয় ৩০/৩৫ বছর আগে। জীবনের তাগিদে শিশু সন্তানকে কোলে নিয়েই করতে থাকেন বিভিন্ন কায়িক শ্রম। অবুঝ শিশুদের মুখ পানে চেয়ে তার জীবনের স্বর্ণালী সময়ে শুরু করা সেই হাড়ভাঙা খাটুনী, তা যেন এ জীবনে আর ফুরায় না। অন্যের বাড়িতে কাজ করেই তিলতিল করে জমানো টাকায় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। একমাত্র ছেলে একটি গার্মেন্টেসে কাজ করে। বিয়ে করে তারা সন্তানসহ ঢাকায় থাকে। খোঁজ নেয় না মায়ের।

বয়সের ভারে লালতারা বেওয়ার শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা অসুখ বিসুখ। এখন আর আগের মতো কাজ করতে পারেন না। দুবেলা দুমুঠো ভাত খাচ্ছেন তিনি ঠিকই, কিন্তু তা অন্যের দয়ায়। বললেন, ‘বছর তিনেক আগে ঈদের দিন তার ছেলে আসছিল; তিনশো ট্যাকা দিয়ে গেছে। মেয়ের বিয়া অইছে ম্যালা বড় বাড়িতে; আমার পরিচয় দেয় না, ওগো খুব লজ্জা লাগে। সারাডা জীবন রক্ত পানি কইরা ওগোরে বড় করলাম যাতে শেষ বয়সে ওরা আমারে দ্যাহে (দেখে), তা আমার কপালে সইলো না। এমন কপাল আল্লায় যেন কাউরে না দ্যায়। তবুও দোয়া করি আল্লায় যেন ওগোরে সুখে রাখে। কথা বলার সময় দু’চোখের কোণে পানি টলমল করছিল। বার বার কাপড়ের আঁচল দিয়ে পানি মোছার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হন। এক পর্যায়ে কেঁদে ওঠেন হাউমাউ করে অস্ফুট স্বরে শুধু বললেন, ওগো দেখবার খুউব মন চায়, কত দিন দেখিনা ওগোরে। কতদিন মা যাক শুনি না।’

শুধুমাত্র বেঁচে থাকার তাগিদে বৃদ্ধ বয়সে এসেও ভিক্ষা করতে হচ্ছে এক অসহায় মা হাজেরা বেগমকে। ঘিওরের তরা এলাকায় খুড়িয়ে খুড়িয়ে ভিক্ষা করছেন তিনি। বয়সের ভারে বৈশাখের তপ্ত দুপুরে ঠিকমতো পথও চলতে পারছিলেন না। ছেলে রায়হান বিয়ে শাদী করে শশুর বাড়িতে থাকে। একটিবারও খোঁজ নেয় না গর্ভধারিনী এই মায়ের। তবু সন্তানের প্রতি তার কোন আক্ষেপ নেই। মা দিবস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে বেশ অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে উওর দেন, সেইডা আবার কি বাপু, এই কতা তো আগে হুনি (শুনি) নাই। এসব দিবসের চাইতে জীবন বাঁচানোর তাগিদই তাদের কাছে এখন মুখ্য। তবুও তারা সবসময় দোয়া করে তার সন্তান যেন ভালো থাকে।

বিষন্ন আকাশ পানে শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছেলেটি। আকাশের বুকে জমা হওয়া মেঘের মতই একরাশ কাল মেঘ জমে আছে তার মানস পটে। গুমোট মেঘের দল যেকোন সময় কান্না হয়ে ঝড়ে পড়বে। আকাশের মেঘ কেটে সূর্য হাসলেও ছেলেটির মনে আনাগোনা করা গুমোট মেঘের দল কখনও সড়বে না, কারণ যে সূর্য দূর করবে অন্ধকার- সেই সূর্যকে হারিয়ে ফেলেছে ছেলেটি। সেই আলোক উৎস হারিয়ে গেছে ছেলেটির জীবন থেকে। কারণ তার জীবনে সেই সূর্যটি নেই, ছেলেটির মা নেই এই পৃথিবীতে। হ্যাঁ, এই ছেলেটির মত হতভাগা আর কে বা আছে?

ঘিওর এলাকার মজলিশ মল্লিকের স্ত্রী আলেয়া বেগম আজ থেকে চার বছর আগে নিহত হয় রানা প্লাজা ধ্বসে। তখন তার ঘরে ছিল দুই বছরের একমাত্র ছেলে। অস্ফুট স্বরের সেই মা..আ ডাকটি হারিয়ে গেছে চির কালের জন্য। ছেলেটির বয়স এখন ছয় বছর। ভালোই কথা বলতে পারে ফুটফুটে মুখে। এখন সে বুঝতে শিখেছে, হাজারবার মা..মা বলে ডাকলেও কিন্তু একটি বারের জন্যও যে মা আর আসবে না। পরিবারের সব সদস্যরা হয়তো বেশ সুখেই রাখার প্রচেষ্টা করছে তবুও মায়ের অপূরণীয় অভাব তাড়িয়ে বেড়ায় শিশুতোষ মনটাকে। কোমল নয়নজোড়া এখনো খুঁজে বেড়ায় তার মাকে।

কান্না মিশ্রিত এসব দুঃখগাঁথার বিপরীতে আছে কিছু সুখের পংক্তিমালা। সন্তানদের সুখের জন্য একজন মা যে কতটা কষ্ট করেন তার একটি উদাহরণ মানিকগঞ্জের আরুয়া ইউনিয়নের বাউলিকান্দা গ্রামে মর্জিনা বেগম। ১৮ বছর আগে দুই শিশু সন্তান রেখে মর্জিনা বেগমের স্বামী ঢাকায় কাজের খোঁজে গিয়ে আর ফিরেননি। পরে জানতে পারেন তিনি মারা গেছেন। এরপর থেকেই শুরু হয় তার জীবনযুদ্ধ। সংসারের হাল ধরতে কখনো অন্যের বাড়িতে, কখনো আবার কাজ করেছেন ফসলের মাঠে। এখনো মর্জিনা বেগম কেয়ার বাংলাদেশের হয়ে ইউনিয়ন পরিষদের একজন তালিকাভুক্ত মাটি কাটা শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। কিন্তু এই সংগ্রামী নারী তার ছেলেকে বানাচ্ছেন এমবিবিএস ডাক্তার। ছেলে রিপন বিশ্বাস ঢাকার একটি মেডিক্যাল কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্র। মেয়ে সুরমা আক্তার এইচএসসি পরীক্ষার্থী। তাকেও আইনজীবী বানাতে মা চান মর্জিনা।

মর্জিনা বেগম জানান, অভাবের মধ্যে দুই ছেলে-মেয়ের লেখাপড়াকে আত্মীয়-স্বজন আর প্রতিবেশিরা বাঁকা চোখে দেখতো। তাদের লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়ে কাজে লাগানোর পরামর্শ দিয়েছেন অনেকে। কিন্তু ছেলের একের পর এক ভালো রেজাল্টে সবাই খুশি হয়েছেন। এ পর্যন্ত আসার পেছনে এলাকাবাসীও অনেক আর্থিক সহযোগিতা করেছেন। মুখে এক গাল তৃপ্তির হাসি হেসে তিনি জানান, আজ আর আমার কোনো কষ্ট নেই। আমি সব কষ্টের কথা ভুলে গেছি। ছেলে আমার ডাক্তার হইছে, গরিব দুখীর সেবা করতে পারবে। মেয়েকে উকিল বানাবে, যেন সেও মানুষকে আইনি সেবা দিতে পারে। ছেলে রিপন বিশ্বাসও তার মায়ের এই কষ্টে অঝরে কাঁদে। তার স্বপ্নও একদিন তার মায়ের মুখে সে পরিতৃপ্তির হাসি ফুটাবেই। তার গর্ব সে একজন আদর্শ মায়ের গর্ভে জন্মেছিল।


শেয়ার করুন