আক্রাহ কারাগারের ফেরেশতারা

akrah-jail-artists-5বাংলামেইল:

সিরিয়ার ক্বামিশলি থেকে পালিয়ে আসা চৌদ্দ হাজার শরণার্থী আশ্রয় নিলো কুর্দিস্তানের আক্রাহ শহরে। এখানেই ঐ কুখ্যাত আক্রাহ কারাগার, সাদ্দাম হুসেইনের বিরুদ্ধাচরণকারী থেকে শুরু করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের ধরে নিয়ে এসে যেখানে নির্যাতন চালানো হতো এককালে। কারাগার আর আগের রূপে নেই, এর মধ্যে দজলা ফোরাতে তো অনেক জল গড়িয়ে গেছে। ইরাকে নগ্ন সশস্ত্র আগ্রাসন থেকে চোখচাওয়া পথে সরে দাঁড়িয়েছে আমেরিকানরা, আর মুখে বলা ইসলামি খিলাফতের স্বপ্ন নিয়ে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আল-কায়েদা থেকে বিচ্ছিন্ন কালো পতাকার দল দায়েশ। একেএকে ইরাকী নৃগোষ্ঠীগুলোকে খেদিয়ে, ঐতিহ্যময় স্থাপনা গুঁড়িয়ে, পুস্তকাগার পুড়িয়ে বিস্তৃর্ণ এলাকার দখল নিয়েছে ওরা। কুর্দিস্তানও ওদের হাতে হুমকির মুখে, যদিও এখনও অনেকটাই প্রভাবমুক্ত রাখতে পেরেছে নিজেদের। যে কারণে দিনরাত তটস্থ হয়ে সীমান্ত পাহারা দিচ্ছে কুর্দিসেনারা, আর থেকে থেকে গর্জে উঠছে তাদের কামান। এমন সময়ে ইরাক ও সিরিয়ায় তাবৎ দায়েশ-অধীকৃত এলাকা থেকে মানুষ তুলনামূলক নিরাপত্তার খোঁজে এসেছিল ঐ শরণার্থী মানুষগুলো। দলে ছিল অশীতিপর বৃদ্ধ, মধ্যবয়স্ক ও শিশু। আমাদের গল্প ঐ শিশুগুলোকে নিয়ে।

দুটো শিশু যদি একই স্থান-কালে থাকে, তো প্রথমেই একে অপরের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করে। এর হাত ধরেই তাদের ভেতর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, যা সামাজিকতার প্রথম ও প্রধান পাঠ। আবার একটি শিশু যখন একা বসে থাকে, তখন হাতের কাছের ডাল বা ইটের টুকরোটি দিয়ে সে মাটিতে বা দেয়ালে আঁচড় কাটে, প্রকৃতি বা পরিজনদের কারও ছবি, কোনো মুখ আঁকতে চেষ্টা করে। এটা মানুষের সহজাত শিল্পীসত্ত্বার প্রথম আত্মপ্রকাশ। শরণার্থী শিবিরে আসা ছোট ছোট শিশুরা ক’দিনের মধ্যেই নিজেদের ভেতর বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেললো, আর দেয়ালে দেয়ালে জানান দিতে শুরু করলো, হাঁ, শিল্পীরা এসে গেছে এখনও ধর্মীয় বা বিবিধ বিধিনিষেধ আরোপ করে যাদের সৃষ্টিশীলতাকে বন্ধ করে দেয়া হয়নি।

যুদ্ধফেরত শরণার্ধী শিবিরের শিশুরা কী আঁকে, তার ওপর একটা মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা হতে পারে। তারা আঁকে মৃত মানুষ, বিচ্ছিন্ন দেহের ছবি, রক্ত, পিস্তল, আর বিস্ফোরণ। কারণ পৃথিবীতে এসেই মনের কাঁচা মাটিতে ওগুলোর ছাপ তারা বাধ্য হয়েই নিয়েছে। কারণ তারা চোখের সামনে তাদের কাছের মানুষটিকেই মরতে দেখেছে, নিজেদের বাড়িটাকেই পুড়তে দেখেছে। ভারাক্রান্ত শিশুমনগুলো ভবিষ্যতের কোন ইমারত গড়বে তা বলা যায় না। শিশুমনের ভাবনাকে একটু ভিন্ন পথে প্রবাহিত করে তাদের মনোজগতকে বাঁচানোর ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা নিতে এগিয়ে আসে আরবিলের একটি বেসরকারী সংস্থা। নিউজিল্যান্ডের শিল্পী লুসি টিন্ডলকে সামনে রেখে এক ছবি আঁকা কর্মশালা আয়োজন করে সংস্থাটি, যে কর্মশালার বাংলা নাম দাঁড়ায় ‘প্রাসাদচিত্র।’ প্রাসাদচিত্র কর্মশালার আওতায় বাচ্চাদের হাতে যখন তুলি আর রং তুলে দেয়া হলো, আর শেখানো হলো নরতুন করে ভাবতে আর অল্প কিছু কৌশল। তাতে যা ঘটে গেলো তা রীতিমতো বিপ্লব!

যে শিশুরা আঁকতো মৃত মানুষ, আগুনে পোড়া দেহ, বিস্ফোরণে ধসে পড়া ঘরবাড়ি, বন্দুকছোড়ার দৃশ্য, তারা কী আশ্চর্য দার্শনিক সব শিল্পকর্মের জন্ম দিতে শুরু করলো। খাঁচার ফাঁক গলে একটি পাখি উড়ে যাচ্ছে, তাকে সাহায্য করছে তার বন্ধু এক মানুষ, অন্ধকার ঘরের দেয়াল ফেঁড়ে বাইরের বাগানে বেরিয়ে আসছে এক সংগ্রামী মানুষ তার হাতের আঙুল দেখা যাচ্ছে, পলমিরার নান্দনিক স্তম্ভগুলোর ওপর ফুল ফুটেছে ঘুড়ি উড়ছে আর ভালোবাসার চিহ্ন ফুটে উঠেছে দেয়ালে দেয়ালে। সিরীয় শিশুদের একজন এক ভাঙা দেয়ালে এঁকেছে স্বদেশের মানচিত্র। তাদের ছবিগুলোর মধ্যে বস্তুগুলোর অবস্থান ও ‍দূরত্ব-নির্মাণ যেন দক্ষ কোনো শিল্পীর হাতে আঁকা। লুমি টিন্ডাল জানালেন তাদের অসাধারণ মেধার কথা। অন্ধ কারাগারের দেয়াল ঘেরা শরণার্থী শিবিরে বাস করতে থাকা মানুষগুলোর মনে যা স্বর্গ, প্রেম আর স্বাধীনতার কথাই মনে করিয়ে দেয়। সলিন ইসমাইল আর নাদ্রিনের মতো শিশুরা ঐ স্বর্গকথার স্বপ্নশিল্পী। ওদের ভালো হোক।


শেয়ার করুন