আকাশ প্রদীপে দিল্লির পথে প্রধানমন্ত্রী

বছর পর প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরে ভারতের পথে ঢাকা ছেড়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তার এই সফরে ভারতের সঙ্গে সাইবার নিরাপত্তা, প্রযুক্তি, পরমাণু বিদ্যুৎ, প্রতিরক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে তিন ডজন চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বোয়িং ৭৭৭ আকাশ প্রদীপ শুক্রবার সকাল ১০টা ১০ এ প্রধানমন্ত্রী ও তার সফরসঙ্গীদের নিয়ে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে নয়া দিল্লির পালাম বিমান ঘাঁটির উদ্দেশ্যে রওনা হয়।

অর্থমন্ত্রী এম এ মুহিত, সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, জাতীয় সংসদের প্রধান হুইপ আ স ম ফিরোজ, তিন বাহিনীর প্রধান, পুলিশ pm-al-rally-3edমহাপরিদর্শকসহ অসামরিক-সামরিক ঊর্ধতন কর্মকর্তারা বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রীকে বিদায় জানান।

তৃতীয় দফায় বাংলাদেশের সরকার প্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার পর এটাই ভারতে শেখ হাসিনার প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফর।

২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরের বছরের ১৯ অগাস্ট ভারতে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির স্ত্রী শুভ্রা মুখার্জির শেষকৃত্যানুষ্ঠানে যোগ দিতে দিল্লি গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা।

এরপর ব্রিকস-বিমসটেক আউটরিচ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে গত অক্টোবর গোয়ায় দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তবে এই দুটির কোনোটিই দ্বিপক্ষীয় সফর ছিল না।

চার দিনের সরকারি সফরে শেখ হাসিনা থাকবেন নয়া দিল্লিতে রাষ্ট্রপতি ভবনে, ভারতের কূটনীতিকদের দৃষ্টিতেও যা বিরল ঘটনা।

ভারতের বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী পীযূষ গোয়াল বৃহস্পতিবার একদল বাংলাদেশি সাংবাদিককে বলেন, “আমরা সবাই আগ্রহ নিয়ে ওই বৈঠকের দিকে তাকিয়ে আছি। এই বৈঠক আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নতুন পর্যায়ে নিয়ে যাবে।”

তিনি বলেন, গত তিন বছরে দুই দেশের আন্তঃসম্পর্কের উন্নয়নে ‘নজিরবিহীনভাবে’ সহযোগিতার সুযোগ সম্প্রসারিত হয়েছে।

“আমাদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা রয়েছে। ১৯৭১ সালের পর কখনও দুই দেশের মধ্যে এমন আস্থা ছিল বলে আমার মনে হয় না।”

ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবন, এই সফরে এখানেই থাকবেন শেখ হাসিনা- ছবি: রয়টার্স
ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবন, এই সফরে এখানেই থাকবেন শেখ হাসিনা- ছবি: রয়টার্স

সফরসূচি
ভারতের স্থানীয় সময়ে বেলা ১২টা ২৫ মিনিটে প্রধানমন্ত্রীর নয়া দিল্লিতে পৌঁছানোর কথা। তাকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে উপস্থিত থাকবেন নরেন্দ্র মোদীর সরকারে বাঙালি প্রতিমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়।

বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে যাওয়া হবে রাইসিনা হিলে- ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বিকাল সাড়ে ৪টায় সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাত করবেন।

সন্ধ্যায় নয়া দিল্লিতে বাংলাদেশ হাই কমিশনারের দেওয়া অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন প্রধানমন্ত্রী।

শনিবার সকালে রাষ্ট্রপতি ভবনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে আনুষ্ঠানিক অভ্যর্থনা দেওয়ার পর রাজঘাটে মহাত্মা গান্ধীর সমাধীতে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন শেখ হাসিনা।

এরপর হায়দ্রাবাদ হাউজে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে একান্ত বৈঠক এবং পরে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে অংশ নেবেন বাংলাদেশের সরকারপ্রধান।

দুই দেশের মধ্যে প্রায় তিন ডজন চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হওয়ার পর শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদী হিন্দি ভাষায় ‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর’ মোড়ক উন্মোচন করবেন। তরে দুই দেশের সরকার প্রধান যৌথ সংবাদ সম্মেলনে যোগ অংশ নেবেন। সবশেষে শেখ হাসিনা তার সম্মানে মোদীর দেওয়া মধ্যাহ্নভোজে যোগ দেবেন।

শনিবার বিকালেই মানেক শ সেন্টারে মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর শহীদের সম্মাননা অনুষ্ঠানে যোগ দেবেনন হাসিনা। ভারতের উপ-রাষ্ট্রপতির সঙ্গেও তার সাক্ষাতের সূচি রয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী রোববার আজমির শরীফ যাবেন। সেখন থেকে দুপুরেই দিল্লি ফিরবেন এবং বিকালে কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাত করবেন।

পরে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বৈঠক করবেন শেখ হাসিনা। রাতে রাষ্ট্রপতি ভবনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পর নৈশভোজে অংশ নেবেন তিনি।

সোমবার সকালে ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনের সংবর্ধনায় অংশ নেওয়ার পর হোটেল তাজমহলে ব্যবসায়ীদের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। সফর শেষে সেদিন বিকালেই রওনা হবেন দেশের পথে।

২০১৫ সালের জুনে ঢাকা সফর করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
২০১৫ সালের জুনে ঢাকা সফর করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

তিন ডজন চুক্তি
প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে দুই দেশের মধ্যে সাইবার নিরাপত্তা, প্রযুক্তি, পরমাণু বিদ্যুৎ, বিজ্ঞান ও প্রতিরক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে ৩৫টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার কথা বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী জানিয়েছেন।

তবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাগড়ায় আটকে থাকা তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে এখনও কোনো অগ্রগতি নেই। প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে এর সুরাহা হওয়ার আশাও নেই বললেই চলে।

ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্কর বৃহস্পতিবার বলেন, “আমি আপনাদের বিভ্রান্ত করতে চাই না। সত্যি বলতে আমার কাছে এই মুহূর্তে এমন কোনো কিছু নেই যাতে মনে করতে পারি, আগামী দুই দিনে নাটকীয় কিছু হতে পারে।”

তবে কিছুটা আশার কথা হচ্ছে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির আমন্ত্রণে এক অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ হচ্ছে মমতার, যা তিস্তা নিয়ে অচলাবস্থা নিরসনে ভূমিকা রাখতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।

এই জট খুলতে সময় লাগবে বলে মনে করেন ঢাকায় ভারতের সাবেক হাই কমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী। তবে তাতে দুই দেশের সম্পর্কের অন্যান্য দিক ক্ষতিগ্রস্ত হবে না বলে মনে করেন তিনি।

অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরে তিস্তাকে ছাপিয়ে গেছে সম্ভাব্য প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা।

প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নিয়ে চুক্তি না সমঝোতা স্মারক সই হবে, তা স্পষ্ট করা হয়নি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলীর দুদিন আগের সংবাদ সম্মেলনে।

অন্যদিকে দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে এমন চুক্তি হতে যাচ্ছে বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা তুলেছে বিএনপি। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যতটা দিচ্ছে, ভারত ততটা দিচ্ছে না বলেও অভিযোগ দলটির।

কী ক্ষেত্রে কোন চুক্তি, তা স্পষ্ট না করলেও শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে কিছুই করবেন না তিনি।

সফরসঙ্গী সাড়ে তিনশ
এবার প্রধানমন্ত্রীর ৩৫০ জন সফরসঙ্গীর মধ্যে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতির নেতৃত্বে ২৫৭ সদস্যের প্রতিনিধিরাও রয়েছেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছাড়াও সফরসঙ্গীদের মধ্যে রয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মসিউর রহমান এবং পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো.শাহরিয়ার আলম।

পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ছাড়াও সফরসঙ্গী হচ্ছেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী মো.আমিনুল ইসলাম, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব জাফর আহমেদ খান, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপ্যাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. মাহফুজুর রহমান, সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এম এ এন ছিদ্দিক, রেলপথ সচিব মো. ফিরোজ সালাহ উদ্দিন, তথ্য সচিব মরতুজা আহমদ, বিদ্যুৎ সচিব আহমদ কায়কাউস, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সচিব মো.সিরাজুল হক খান, জন নিরাপত্তা বিভাগের সচিব কামাল উদ্দিন আহমেদ, নৌ-পরিবহন সচিব অশোক মাধব রায়, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো.মাহমুদ রেজা খান, জ্বালানি সচিব নাজিমউদ্দিন চৌধুরী,আইন সচিব আবু সালেহ শেখ মো.জহিরুল হক, টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব আখতার হোসেন ভূইয়া, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সচিব সুবীর কিশোর চৌধুরী, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সচিব কাজী শফিকুল আলম এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব শুভাশীষ বসু।

২৫৭ ব্যবসায়ীদের মধ্যে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ, প্রথম সহ-সভাপতি শফিউল আহমাদ, চিটাগাং চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান, এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক শেখ ফজলে ফাহিম এবং মেট্রোপলিটন চেম্বারের সভাপতি নিহাদ কবীর প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়েছেন।

রাজনীতিবিদের মধ্যে সংসদ সদস্য শেখ হেলাল উদ্দিন এবং আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহও রয়েছেন।


শেয়ার করুন