আইনী প্যাঁচে ঘুরছে কক্সবাজার পৌরসভা

COXSBAZAR NEWS PIC 01-09-201520150901072922শাহেদ ইমরান মিজান, সিটিএন:
কক্সবাজার পৌরসভা নিয়ে আইনী মারপ্যাঁচ যেন শেষ হচ্ছে না। দীর্ঘদিন ধরে একের পর এক আইনী প্যাঁচে পড়ে সঠিক সময়ে নির্বাচন না হওয়া এবং নির্বাচিত হয়েও দায়িত্ব নিতে পারছে না নির্বাচিতরা। বিশেষ করে মেয়র পদ নিয়ে কঠিন আইনী প্যাঁচ যেন শেষ হবার নয়! এই প্যাঁচের যাঁকাকলে ঘুরেই যাচ্ছে পর্যটন রাজধানীর এই পৌরসভা। এর ফলে এই পৌরসভার সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও জনসেবা বরাবরই অবহেলিত থেকে যাচ্ছে। এমনটি মনে করেন কক্সবাজার পৌরসভার জনসাধারণ।
পৌরসভা সূত্র মতে, কক্সবাজার মিউনিসিপ্যালিটি গঠিত হয় ১৮৬৯ সালে। মেহের আলী বিএল কক্সবাজার মিউনিসিপ্যালিটির প্রথম মনোনীত চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি রামু উপজেলার অধিবাসী ছিলেন। ১৯৫৯ সালে কক্সবাজার মিউনিসিপ্যালিটির নাম পরিবর্তন করে টাউন কমিটি করা হয়। ওই টাউন কমিটির প্রথম মনোনীত চেয়ারম্যান ছিলেন আবদুস সালাম। তিনি কক্সবাজার পৌর এলাকার বাহারছড়ার বাসিন্দা ছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে টাউন কমিটির নাম পরিবর্তন করে কক্সবাজার পৌরসভা করা হয়।
সূত্র মতে, ১৯৮৪ সালে কক্সবাজার পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন নূরুল আবছার। নিয়ম মতে ৫ বছর পর পর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু ১৯৯৩ সালের পর পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০০২ সালের ১৫ জুন। এরপর দীর্ঘ নয় বছর পর সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি। আইনী জটিলতার কারণে নির্বাচনের এই দীর্ঘসূত্রিতা হয়। তবে এর মধ্যে সরকারি জটিলতাও রয়েছে। ২০০২ সালের নির্বাচনের পর ২০০৭ সালের নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও সেনা শাসিত জরুরী অবস্থায় আর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি।
১৯৮৪ সালের পর টানা চারবার চেয়ারম্যান ও মেয়র নির্বাচিত হন সেই সময়ের তুমুল জনপ্রিয় নেতা নূরুল আবছার। কিন্তু ২০০৪ সালে দুর্নীতি মামলায় মেয়র থেকে বরাখাস্ত হন নূরুল আবছার। তারপর তাঁর ইশারায় কমিশনার সরওয়ারম কামাল ভারপ্রাপ্ত মেয়র হন।
কথিত রয়েছে, সে সময় কমিশনারদের মধ্যে নূরুল আবছারের একমাত্র বিশ্বস্ত ছিলেন সরওয়ার কামাল। তাই নিজের অনুপস্থিতিতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে, বহু কাঠগড় পুড়িয়ে সরওয়ার কামালকে ভারপ্রাপ্ত মেয়র করেছিলেন তিনি। কিন্তু দিন গেলে পাল্টে যায় প্রেক্ষাপট। আস্তে আস্তে পরিবর্তন ঘটে নূরুল আবছার ও সরওয়ারের সম্পর্ক। সরওয়ার নিজেই নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তৈরি হয়। ততদিনে নূরুল আবছার আর তার সম্পর্ক শেষ! তার শেষ ফলাফল ছিলো, ২০১১ সালের নির্বাচনে নূরুল আবছারের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বি হয়ে দাঁড়ায় সরওয়ার কামাল।
২০১১ সালের নির্বাচনে দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় নির্বাচন করতে পারেননি নূরুল আবছার। নির্বাচনের শেষ একদম শেষ মুহূর্তে এসে প্রার্থীতা বাতিল হয়েছিল তাঁর। নূরুল আবছারের বিরুদ্ধে মামলা, প্রার্থীতা বাতিলসহ সবকিছুতে সরওয়ারের হাত ছিলো। এমন অভিযোগ ছিল নূরুল আবছার ও তাঁর সমর্থকদের। কিন্তু সরওয়ার বরাবরই তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তারপরও নিস্তার হয়নি। তার পরিণতি ছিলো নির্বাচিত হওয়ার আড়াই বছর পর্যন্ত চেয়ারে বসতে পারেননি সরওয়ারসহ পুরো পৌর পরিষদ। তিনবার শপথ গ্রহণের সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পরও শপথ হয়নি। উচ্চ আদালতে রীট করে আইনী মারপ্যাঁচে ফেলে শপথ ঠেকিয়ে রেখেছিলেন নূরুল আবছার। এই ঘটনা স্পষ্টই সবার জানা। তবে সব আইনী লড়াইয়ে লড়ে ২০১৩ সালের ২০জুলাই শপথ নিতে সক্ষম হন বর্তমান পৌর পরিষদ। এর আগে দীর্ঘদিন ভারপ্রাপ্ত মেয়রের চেয়ারে আসীন থাকেন রাজ বিহারী দাশ।
সাধারণ মহল থেকে অভিযোগ উঠে, সেই থেকে আর স্বাভাবিক ধারায় ফিরে আসেননি নূরুল আবছার। এরপর থেকে রাজনীতি থেকে ‘মামলাবাজ’ মন-মানসিকতাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন তিনি। তাঁর কারণেই কক্সবাজার পৌরসভারও আইনী মারপ্যাঁচে ডুবে থাকে। যার সবশেষ ফলাফল মেয়র সরওয়ারের বরখাস্ত আর মাহবুবুর রহমানের ভারপ্রাপ্ত মেয়র হওয়া।
২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াত নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির দন্ডাদেশ বাতিল চেয়ে সাঈদী মুক্তি পরিষদের ব্যানারে কক্সবাজার শহরে বিক্ষোভ করে জামায়াত-শিবির। এতে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে তিনজন মারা যায়। দুই পক্ষের মধ্যে ঘন্টাব্যাপী সংঘর্ষে ২০ পুলিশ সদস্যসহ আহত হয়েছিল অন্তত তিন শতাধিক লোক। এ ঘটনায় পৌর মেয়র সরওয়ার কামালসহ ২৭৩ জনকে আসামী করে পৃথক তিনটি মামলা করে পুলিশ। এই আইনী মারপ্যাঁচে পড়ে ২০১৫ সালের ২৪ নভেম্বর বরখাস্ত হন। সে সময় জনশ্রুতি উঠে, মেয়র সরওয়ারকে আসামী থেকে বরখাস্ত করা পর্যন্ত কাজ করেছিলেন নূরুল আবছার। তাকে যোগান দিয়েছিলেন ১নং প্যানেল মেয়র জিসান উদ্দীন।
মেয়র সরওয়ার কামাল বরখাস্ত হওয়ার পর মেয়র পদ নিয়ে শুরু হয় নতুন মেরুকরণ। ১নং প্যানেল মেয়র হিসেবে জিসান উদ্দীন ভারপ্রাপ্ত মেয়র হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। এমনকি ২নং প্যানেল মেয়র রফিকুল ইসলাম ও ৩নং কুহিনূর আক্তারও মেয়রের চেয়ারে বসতে পারেনি। আইনী মারপ্যাঁরের কারণেই অধিকারভুক্ত হয়েও তারা তিনজনই ভারপ্রাপ্ত মেয়র হতে পারেননি। এরপর শুরু হয় নতুন আইনী মারপ্যাঁচ।
রাতারাতি চকরিয়ায় সরকার বিরোধী নাশকতার মামলা দায়ের করে আসামী করা হয় ১নং প্যানেল মেয়র জিসান উদ্দীন ও ২নং প্যানেল মেয়র রফিকুল ইসলামকে। ফৌজদারী মামলার আসামী হওয়ায় আইনী প্যাঁচে পড়ে মেয়র পদ থেকে ছিটকে পড়ে তারা দু’জন। রহস্যজনক কারণে নিশ্চুপ থাকেন ৩নং প্যানেল মেয়র কুহিনূর আকতার। ফলে ভারপ্রাপ্ত মেয়র হন জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান মাবু। তারপর মাহবুবুর রহমান মাবুর বিরুদ্ধে রীট পিটিশন দায়ের করেন সরওয়ার কামাল। একই সাথে পদ ফিরে পেতে আবেদন করেছেন। কিন্তু সরওয়ারের দায়ের করা এই রীট ৯ ডিসেম্বর খারিজ করে দেন উচ্চ আদালত। তবে এখনো শেষ হয়নি। এই রীট পুুন: প্রক্রিয়া চলছে। গতকালও সরওয়ারের রীট পিটিশনটি পুন: আবেদনের ধার্য্য দিন ছিল। মেয়র সরওয়ার অভিযোগ করেন, কৌশলে তার আবেদনটি বার বার কার্যতালিকা বাদ দেয়া হচ্ছে।


শেয়ার করুন