আইনজীবীর পোষাক-বিধি ও সম্বোধন-রীতি

ad-mohammad-shajahanমোহাম্মদ শাহজাহান, এডভোকেট :

সম্প্রতি ঢাকার জেলা জজ আদালতে ‘বিচার বিভাগে সমন্বয়: চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দানকালে বাংলাদেশের সুপ্রীম কোর্টের মাননীয় প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা আইনজীবীদের পোষাক-বিধি পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, আইনজীবীদের কালো কোট আর গাউনের পুরনো পোষাক বিধি এখন আর বাস্তবসম্মত নয়। এ নিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বয়ানে তিনি বলেন, দেশে বিদ্যুৎ -বিভ্রাটের শেষ নেই। আদালতের কার্যক্রম চলাকালে বিদ্যুৎ চলে গেলে বিচারক/বিচারপতিগণ ছোট পাখার সুবিধা পেলেও আইনজীবীরা প্রচন্ড গরমে অসহনীয় দুর্ভোগ পোহান। ফলে গ্রীষ্মকালে কোট গায়ে ওকালতির নিয়ম বদলানোর এখনই সময়। আইনজীবীদের পোষাক বিধির প্রবর্তক ইংরেজদের কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ইদানিং ইংরেজ আইনজীবীদেরও আদালতের কার্যক্রম চলাকালে কালো কোট আর গাউন পরিধানের নিয়ম বদলানো হয়েছে। এ কারণে এদেশের আইনজীবীদেরও এ নিয়মে সংস্কার দাবী করা উচিত ও এতে দেশের বর্তমান প্রধান বিচারপতি হিসেবে তাঁর পূর্ণ সমর্থন রয়েছে/থাকবে মর্মে জানান তিনি।
বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের হিসেব অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ৪৬ হাজারের অধিক আইনজীবী রয়েছেন। এর মধ্যে সিংহভাগ আইনজীবী দেশের জেলা পর্যায়ের আদালতে ও বাকীরা মহামান্য সুপ্রীম কোর্টে কর্মরত রয়েছেন। আদালতের কার্যক্রম চলাকালে তাঁদের বাধ্যতামূলকভাবে কালো কোট, কালো গাউন, কালো/সাদা প্যান্ট, সাদা শার্ট ও কালো জুতো পরিধান করতে হয়। সাথে কালো টাই বা সাদা ব্যান্ড তো রয়েছেই।
গ্রীষ্ম-প্রধান ষড়ঋতুর এই দেশে সারা বছর একই নিয়মের পোষাক বিধি মেনে চলতে হয় আইনজীবীদের। ব্যাপারটি শীত মৌসুমে স্বস্তিদায়ক হলেও বছরের বেশির ভাগ সময় অত্যন্ত কষ্টদায়কই বটে। গ্রীষ্মকালীন লোড়শেডিং-এর কারণে পেশাগত পোষাক পরিহিত অবস্থায় অনেক আইনজীবী অসুস্থও হয়ে পড়েন। আইনে স্নাতক কিছু মানুষ এমনও আছেন যাঁরা ওই পোষাক বিধির কারণে আইন পেশায় যোগদানই করেননি শেষ পর্যন্ত। পশ্চিমা শীত-প্রধান দেশের জন্যে এই পোষাক বিধি উপযুক্ত হলেও বাংলাদেশের মতো গ্রীষ্ম-প্রধান ও লোড়শেডিং-কবলিত দেশের জন্যে সেটি কেবল অযৌক্তিকই নয়, অমানবিকও।
পোষাক বিধির কারণে বাধ্য হয়েই গরমের দিনে কোট, গাউন ও টাই পরিধান করেন আইনজীবীরা। অন্যথায় বিজ্ঞ আদালতে আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালনে অনুমতি মেলে না। কারণ, তাতে আইন লঙ্ঘিত হয়। আর আইনজীবীদের জন্যে প্রযোজ্য এই পোষাক বিধি বর্ণিত রয়েছে সিভিল রুলস এন্ড অর্ডারস, সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের রুলস বা বিধিমালাতে।
শুধু পোষাক বিধিতেই নয়, উচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারপতিদের আইনজীবীরা যে শব্দ-বন্ধ ব্যবহার করে সম্বোধন করেন, তাতেও সংস্কার দরকার। আমাদের দেশে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের ‘মাই লর্ড’ সম্বোধন করতে হয়। ‘মাই লর্ড’-এর শাব্দিক অর্থ বাংলায় ‘আমার প্রভু’। তাই এই সম্বোধন ব্যবহারে অনেকেই অস্বস্তিতে ভোগেন,যদিও পেশাগত কারণে আইনজীবীরা এই অস্বস্তি প্রকাশ করেন না। সাংবাদিক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত বহুল আলোচিত আদালত অবমাননার মামলায় মাহমুদুর রহমান আইনজীবী নিয়োগ না করে নিজেই মামলা পরিচালনা করেছিলেন। এ সময় তিনি বিচারপতিগণকে ‘মাই লর্ড’ সম্বোধনে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।
দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব ক’টি দেশেই আইনজীবীদের পোষাক বিধি ও সম্বোধন রীতি প্রায় একই বলা যায়। ভারতের এক অঙ্গ রাজ্যের হাইকোর্টে পোষাক বিধি পরিবর্তনের লক্ষ্যে পরপর দুইটি রীট আবেদন দাখিল করেছিলেন আইনজীবীরা। তবে ওই হাইকোর্ট দুইটি রীট আবেদনই নাকচ করে দেন।অবশ্য, বছর কয়েক আগে সর্ব-ভারতীয় আইনজীবী সমিতি ‘মাই লর্ড’-এর পরিবর্তে ‘ইউর অনার’, ‘লার্নেড কোর্ট’ ইত্যাদি সম্বোধন হিসেবে ব্যবহারের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেন। সেই থেকে ভারতের আদালতে ‘মাই লর্ড’ সম্বোধন ব্যবহৃত হচ্ছে না আর। বরং সব আদালতে ‘ইউর অনার’ সম্বোধনই চালু হয়ে গেছে এর মধ্যে।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, খোদ ইংরেজরাই আইনজীবীদের ওই পুরনো পোষাক বিধি পাল্টেছেন ইতোমধ্যে। কিন্তু ওদেরই তৈরি ও পরে পরিত্যক্ত এই বিধি আমরা এখনও আঁকড়ে ধরে আছি। এদেশের আবহাওয়া, ধর্মীয়, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক আঙ্গিকের বিপরীতে। উপনিবেশিক দাসত্বসুলভ মন-মানসিকতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ এ ছাড়া আর কী হতে পারে!
মাননীয় প্রধান বিচারপতির ঘোষিত পূর্ণ সমর্থনকে কাজে লাগিয়ে আইনজীবীদের পোষাক বিধি ও সম্বোধন রীতি এ দেশের আবহাওয়া ও পরিবেশ-পরিস্থিতির নিরিখে সংস্কারে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। এ নিয়ে সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতি, বাংলাদেশ বার কাউন্সিল ও দেশব্যাপী আইনজীবী সমিতিসমূহের সক্রিয়তার বিকল্প নেই।
মোহাম্মদ শাহজাহান: এডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, কক্সবাজার।


শেয়ার করুন