অ্যাপস বন্ধ করে নাশকতা ঠেকানো সম্ভব?

বাংলামেইল:

apps নাশকতা ঠেকাতে সরকার ইন্টানেটে ফ্রি কল, চ্যাট ও কনটেন্ট আদান প্রদানের জনপ্রিয় অ্যাপস ভাইবার, ট্যাঙ্গো, হোয়াটসঅ্যাপ, মাইপিপল ও লাইন বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। আগামী ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে। তবে প্রয়োজনে এ সময়সীমা বাড়তেও পারে। এতে করে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ বন্ধ করে নাশকতাকারীদের বিরত করা যাবে বলেই মনে করছে সরকার।

তবে সরকার নিরাপত্তার অজুজহাতে এভাবে যোগাযোগের মাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও তা প্রকৃতপক্ষে কার্যকর পদক্ষেপ নয় বলে মনে করছেন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা।

সম্প্রতি পাকিস্তান, সৌদি আরব, তুরস্ক এবং মিশরে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়নি। বিকল্প উপায়ে এসব অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করা সম্ভব। এছাড়া এর আগে ইউটিউব ও ফেসবুকও বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। সবাই প্রক্সিতে ব্যবহার করেছে। যারা একটু প্রযুক্তি বোঝেন তারা নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে এসব অ্যাপ ব্যবহার করতে জানেন।

এ ব্যাপারে প্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জব্বার বাংলামেইলকে বলেন, ‘কোনো প্রযুক্তির ব্যবহার বন্ধ করে দিয়ে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় না। বিটিআরসি ভাইবারের সাইট বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু ভাইবারের ব্যবহার বন্ধ করতে পারেনি। কেননা, ভাইবারের জন্য একটি ফোন নম্বরের প্রয়োজন হয়। কেউ যদি এক্ষেত্রে বিদেশি নম্বর ব্যবহার করে তবে তাকে ভাইবার ব্যবহার ঠেকানো যাবে না। এসব প্রযুক্তি বন্ধ করলেও বিকল্প পদ্ধতি ঠিকই আছে।’

তিনি মনে করেন, এতে করে সরকারে ইমেজ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। একই সঙ্গে সরকারের জনপ্রিয়তা কমছে। নাশকতার অভিযোগে এমন উদ্যোগ যুক্তিহীন। সরকার যদি গোয়েন্দাগিরি করতে চায় তবে ঘরে বসেই ট্র্যাকিং করে কাজটা করতে পারে। একের পর এক অ্যাপস বন্ধ করা যুক্তিহীন।

উল্টো বিটিআরসিকে দোষ দিয়ে মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘ভাইবার বন্ধ করার পেছনে মোবাইল অপারেটরদের ষড়যন্ত্র আছে কি না সেটা খতিয়ে দেখা উচিৎ। বহুজাতিক বেনিয়াদের কোনো ভরসা নেই। বিটিআরসি ওদের ক্রীতদাস!’

আরেকটা কথাও উঠে আসছে যে, এসব সেবা বন্ধ করে দেয়ার মানেই হলো সরকার কার্যকরভাবে নজরদারি করতে সক্ষম নয়। অবশ্য প্রযুক্তিবিদদের মতে, এ কাজটা সম্ভবও নয়। কারণ আজকাল কয়েকজন প্রোগ্রামার মিলে রাতারাতি অ্যাপস বানিয়ে ফেলছে।

তার মানে কি প্রযুক্তি বিষয়ে ধারণা না থাকার কারণেই এইসব আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত আসছে? এতে কিন্তু খামাখাই সাধারণ মানুষ হয়রানির স্বীকার হচ্ছে। এ ধরনের সিদ্ধান্তকে হস্যকর বলেও উল্লেখ করছেন অনেকে।

বাংলাদেশে সফটওয়ার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুর বাংলামেইলকে বলেন, ‘বন্ধ করা পাঁচটি অ্যাপস সম্পর্কে সরকারকে যারা তথ্য দিয়েছে তাদের নিশ্চয়ই প্রযুক্তির জ্ঞান নেই। মানুষ এখন শুধুমাত্র মোবাইল ফোনের মাধ্যমেই কথা বলে না। কথা বলার জন্য, এসএমএস পাঠানোর অনেক উপায় আছে। একটার বিকল্প অন্যটা দিয়েও হয়। গুগল দিয়েও ম্যাসেজ পাঠানো যায়। সরকার তাই বলে গুগলও বন্ধ করে দেবে?’

তিনি আরো বলেন, ‘এটা সরকারের একটা হঠকারী সিদ্ধান্ত। এতে করে প্রযুক্তিখাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। মানুষ ইন্টারনেটের মাধ্যমেই সহজেই যোগাযোগ করতে পারছে। তাই সরকারের নাশকতা ঠেকাতে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেয়া কোনো যুক্তির মধ্যে পরে না। এটা সরকার না বুঝেই করছে।’

এছাড়া সরকার যদি নজরদারি করতেই চায় তাহলে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থায় আড়িপাতা সম্ভব। এটা অবশ্য নির্ভর করে সরকারের কারিগরি সক্ষমতার ওপর। কারও অবস্থান শনাক্ত করতে হলে ব্যক্তি যে ডিভাইস বা যন্ত্রে কথা বলছেন সেটা ট্র্যাক করা জরুরি। আর এর জন্য দরকার বিশেষ প্রযুক্তি। তবে তরুণ প্রোগ্রামাররা অনেক চালাক। তারা জিপিএস প্যানেলিং করে সরকারের নিষেধাজ্ঞা বাইপাস করে বিদেশে কথা বলে। তার মানে আসলে ভাইবার বা এ ধরনের সফটওয়্যারের সেবা বন্ধ করাটা কার্যকর কোনো পদক্ষেপ হতে পারে না।

এদিকে বিএনপির একজন নেতা বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, ভাইবার বন্ধ করে দেয়ার পর তারা নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছেন। কারণ তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য এই সার্ভিস ব্যবহার করতে পারছেন না।

তার মানে এমন ধারণা যৌক্তিক যে, টেলিফোনে আড়িপাতা হতে পারে এমন আশঙ্কায় বিএনপি নেতাকর্মীরা অথবা নাশকতাকারীরা মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে না। ভাইবার বা এ জাতীয় অ্যাপসগুলো ব্যবহার করা হলে ব্যবহারকারীকে ট্র্যাক করা কঠিন হয়ে পড়ে। আর সরকারের এতো চৌকস সিক্যুরিটি এক্সপার্ট নেই। এ কারণেই হয়ত সহজ উপায় হিসেবে এসব অ্যাপস বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজম্যান্ট ইনফরমেশন সিস্টেম(এমআইএস) বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আশীষ তালুকদার বলেন, ‘মোবাইল ফোনে কল ট্র্যাক করা সহজ কিন্তু ভাইবারের মতো অ্যাপসগুলোর কল, এসএমএস ট্র্যাক করা কঠিন, তবে সম্ভব। সরকারের আইটি এক্সপার্টদের অভাব রয়েছে।’

আশীষ তালুকদার আরো বলেন, ‘জননিরাপত্তার স্বার্থেই সরকার এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। এর আগেও ফেসবুক, ইউটিউব বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তারপরও মানুষ বিকল্প উপায়ে এগুলো ব্যবহার করেছে। এটা যদি সাময়িক সময়ের জন্য তবে ঠিক আছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদের জন্য হলে জনগণ মানবে না। আশা করছি, খুব শিগগিরিই সরকার বন্ধ করা অ্যাপসগুলো খুলে দেবে।’

তবে বর্তমানে অ্যাপসের যেভাবে উন্নয়ন হচ্ছে তাতে অ্যাপস বন্ধ করা কোনো কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে না এ ব্যাপারে সবাই একমত। কারণ ভাইবারের মতো অনেক অ্যাপস আছে। এছাড়া প্রতিনিয়ত এরকম নতুন নতুন অ্যাপস তৈরি হচ্ছে। আপাতত হয়ত সরকারের কাছে মাত্র পাঁচটি অ্যাপসের তথ্য আছে বলে এগুলো বন্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এখনো যেগুলো বাকি আছে বা নতুন যেগুলো তৈরি হচ্ছে সেসব ঠেকাবে কী করে? তাছাড়া বন্ধ করে দেয়া অ্যাপসগুলোও একটু ট্রিকস খাটিয়ে নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে ব্যবহার করা সম্ভব।


শেয়ার করুন