অব্যাহতিপ্রাপ্ত ডেপুটি গভর্নর সুলতানা ছিলেন একাত্তরের সেই মিছিলে!

image-475সিটিএন ডেস্ক:

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে বিদেশে অর্থ চুরির প্রেক্ষাপটে গভর্নর আতিউর রহমান আবেগঘন পরিবেশে পদত্যাগ করলেন। সেই সাথে আরও দুজন ডেপুটি গভর্নরকেও অব্যাহতি দেওয়া হলো। এদের মধ্যে একজন নাজনীন সুলতানা। বাংলাদেশের মানুষের কাছে একটি স্বল্প পরিচিত মুখ। তাঁর বিদায় নিয়ে কেউ চিন্তিত হবেনা, তাঁর চলে যাওয়ায়ও কেউ দুঃখ পাবেনা। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরের বাইরেও তাঁর আরও কিছু পরিচয় আছে যা মানুষের অজানা। নাজনীন সুলতানা একটি বিখ্যাত স্থিরচিত্র এবং একটি মহান ইতিহাসের অংশ।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বদরুন্নেছা কলেজর ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ডামি রাইফেল হাতে ঢাকার রাজপথে ছাত্র ইউনিয়ন নেতা-কর্মীদের সেই বিখ্যাত মার্চপাস্ট এবং সশস্ত্র মহড়ার অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে তিনিও ছিলেন একজন।ফকিরাপুলের বাসার ছাদে লাগানো স্বাধীন বাংলার পতাকাটা ২৫ মার্চের ‘অপারেশন সার্চ লাইট’-এর পর নামিয়ে নেন নাজনীনের বাবা। নাজনীনের মনে তখন সেটা একটা পরাজয়ের রূপ হিসেবেই ধরা দেয়। যে কষ্ট কেবল বিজয়ের আনন্দ দিয়েই ম্লান করে দেয়া যায়, সে কষ্ট দূর করার জন্য বাবা বোঝান স্বাধীন দেশের পতাকা আমরা আবার উড়াবো।

১৯৫৪ সালের জুলাই মাসে বাবা খান ও মা উম্মেহানী খানম এর পঞ্চম সন্তান হয়ে আসেন নাজনীন সুলতানা। সাত বোন এক ভায়ের সংসারে মা ছিলেন নারীবাদী আন্দোলনের কর্মী। মা চাইতেন তাঁর সব মেয়েই শিক্ষিত হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। সেই সময়ে পঞ্চম শ্রেণী পাশ উম্মেহানী খানম পরবর্তীতে মহিলা পরিষদের সাথে যুক্ত থেকে নারীদের পক্ষে দাঁড়ান।নিজের মেয়েদের হাতে খড়িও হয় তাঁর কাছে। পড়ার খরচ কমাতে তিনি সব ছেলে মেয়েকেই বাড়িতে পড়াতেন এবং দুই, তিন ক্লাশ বাদে স্কুলে পাঠাতেন। বাবা-মা সন্তানদের কবিতা, গান আর ছবি আঁকার পথে উৎসাহ নিয়ে আসতেন। বুলবুল ললিতাকলা একাডেমীতে ছবি আঁকা শিখেছেন নাজনীন, সঙ্গে ছিলো কবিতা আবৃত্তি চর্চাও। সে সময়ে শান্তিনগরে আমিনবাগ ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের বার্ষিক অনুষ্ঠানে ঢাকার ছেলে মেয়েরা অংশ নিতো। কিন্তু সবাইকে বেশ একটা হতাশ করে নাজনীনদের ঘরেই চলে আসতো বেশিরভাগ পুরস্কার। পড়াশুনা শুরু হয় রোকেয়া মেমোরিয়াল স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী হিসেবে। ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত এই স্কুলে পড়ার পর মতিঝিল সেন্ট্রাল গার্লস হাইস্কুলে যান এবং এখান থেকেই স্কুলের পাঠ চুকিয়ে ভর্তি হন বদরুন্নেসা সরকারী মহিলা কলেজে। তখন সমগ্র বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল তরঙ্গ স্রেতে ভাসছে। মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য তখন বীর বাঙ্গালি অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছেন। এ মুক্তিযুদ্ধে নারীদের খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করা আর নতুন দেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে যাঁরা সচেতন ছিলেন তাঁদের মতোই নাজনীন ছিলেন প্রত্যয়ী। এসময় বদরুন্নেসা কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের সাধারন সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন নাজনীন। ৬৯ এর গণ আন্দোলনে ভাই মুজাহিদুল ইসলামের অংশগ্রহণে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেদের নেতৃত্বকে বলিয়ান করেন। পরিবারটিই ছিলো ন্যায় পথের যুদ্ধে নিজেকে নিয়োজিত করার মূল প্রেরণা। ৬৯ এর গণ আন্দোলন থেকে ৭১ এর যুদ্ধ পর্যন্ত বদরুন্নেসা কলেজের সকল ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি।

নাজনীনের নেতৃত্বে ৭১ এর মার্চে বদরুন্নেসা কলেজের এক দল শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে ডামি ও পরে সত্যিকারের রাইফেল নিয়ে ট্রেনিং নেন। ট্রেনিং শেষে রাস্তায় মার্চপাষ্ট করা সেই আলোকচিত্রটি আজো ইতিহাস হয়ে আছে জাতীয় জাদুঘর ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। বিভিন্ন জাতীয় দিবসে পত্রিকায় আলোকচিত্রটি ছাপা হয় তখন আবেগে আপ্লুত হন নাজনীন। আর কষ্ট পান অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করতেন না পারার জন্য। অস্ত্র হাতে নিলেও নাজনীন কিন্ত যুদ্ধ থেকে দূরে থাকেননি। মুক্তিযুদ্ধাদের খবর আদান প্রদান , আশ্রয়, ঔষধ আর অর্থের যোগান দেন তিনি। যুদ্ধ শেষে যুদ্ধাহত মুক্তিযুদ্ধাদের সেবা করাটাকে ব্রতি হিসেবে নেন তিনি। স্বেচ্ছা সেবিকা হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মহান সেই যোদ্ধাদের শুশ্রুষার দায়িত্ব পালন করেন।

যুদ্ধ চলাকালে নিজের ডায়েরির পাতা জুড়ে লিখে রাখেন সেই অভিজ্ঞতার কথা। ‘একাত্তরের ডায়েরি’ নামে স্বাধীনতার ৩৭ বছর পর তা গন্থাকারে প্রকাশিত হয়।

পরবর্তীতে উনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞান থেকে পাশ করেন।বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সংসদের সহ সাধারন সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ভাবেন দেশ গড়ার জন্য এখনই লড়াই করতে হবে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশ মাতৃকার টানে। এসময় তিনি উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সাথে যুক্ত ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে যোগ দেন মহিলা পরিষদে। বেগম সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে নারী অধিকার নিয়ে কাজ শুরু হয় তাঁর। এমন এক সময় তৎকালীন ছাত্রনেতা আব্দুল কাইয়ুমের সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগাযোগ দান করেন নাজনীন। উনি বাংলাদেশের প্রথম দিক কার কম্পিউটার প্রোগ্রামার। অনেক আগে থেকেই তিনি বাংলাদেশ ব্যাংককে ডিজিটাল করার স্বপ্ন দেখছিলেন এবং এ নিয়ে কাজ করেও যাচ্ছিলেন। সেইসময় বাংলাদেশের সর্বমোট তিনটি প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ছিল, তাঁর মধ্যে একটি বাংলাদেশ ব্যাংক। শিক্ষিকা হিসাবে যোগদান করার কথা থাকলেও না করে সেই সময় ‘পুরুষের কাজ’ বলে প্রচলিত একটি পেশাকেই বেছে নিয়েছিলেন।তখন বাংলাদেশ ব্যাংকে তিনি সহ মাত্র চারজন নারী কর্মকর্তা ছিলেন।২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে দায়িত্ব পেয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রথম নারী নির্বাহী পরিচালকের। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রথম নারী ডেপুটি গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকে নিজেদের তৈরি ৬৭ টি সফটওয়্যার এপ্লিকেশন চলছে। এগুলো তৈরির ব্যাপারে তাঁর রয়েছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি ডিরেক্টর সৌমিত্র কুমার বিশ্বাস এক ফেসবুক পোস্টে স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন, “নাজনীন আপা আমার দেখা অন্যতম ভালো মানুষগুলোর একজন।আপার উত্থান বাংলাদেশ ব্যাংক দিয়ে না, তাঁর উত্থান মুক্তিযুদ্ধ দিয়ে। আপার সাথে কাজের সূত্রে অনেক দেখা হয়েছে, অন্য বসরা যেখানে মুখ গোমরা করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মত রাশভারী মুখে কথা বলতেন, সেখানে আপনার ব্যবহার ছিল অমায়িক। তাঁর হাত ধরেই বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিজিটাল যুগের সূচনা শুরু। এত অর্জনের পরও এমন দুঃখজনক ভাবে তাকে বিদায় নিতে হবে, এটা কাখনো ভাবিনি।যে হাত দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেছেন, সেই হাত দিয়ে দেশের কোনও ক্ষতি তিনি করতে পারেন, এটা স্বয়ং ঈশ্বর এসে বললেও আমি মানতে নারাজ।”


শেয়ার করুন