অগ্নিচেতনার প্রজ্জ্বলিত শিখার এক নাম শহীদ আবদুল হামিদ

halimকালাম আজাদ:

আবদুল হামিদ (১৯৫০-১৯৭১) একজন সত্যিকার বীর ও খাঁটি বাঙালির নাম। যিনি শত নির্যাতন সত্বেও নিজ দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের নাম শত্র“ পক্ষকে বলতে রাজি হননি, মরার আগ মুহুর্তেও ‘জয় বাংলা’ বলে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন। জন্ম ৪ মার্চ ১৯৫০ সালে চকরিয়ার বমুবিলছড়ি এলাকার বমু গ্রামে। খুবই মেধাবী সন্তান তিনি। নীতিবান শিক্ষক বাবা আবদুল ফাত্তাহর অনেক স্বপ্ন ছিল আবদুল হামিদকে নিয়ে। পড়েছেন চট্টগ্রাম কমার্স কলেজর হিসাব বিজ্ঞান বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স । এ সময় আবদুল হামিদ ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৬৮-৬৯ সালে চট্টগ্রাম কর্মাস কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। মেধাবী ছাত্র আবদুল হামিদ কমার্স কলেজে অধ্যয়ন কালে উনসত্তরের গণঅভুত্থানে যারা চট্টগ্রাম থেকে গণজোয়ার সৃষ্টি করেছেন আবদুল হামিদ ছিলেন তার অন্যতম। আর তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন কমার্স কলেজ থেকেই। গণঅভূত্থানের সময় তিনি শুধু একটি কথাই বলতেন, উগ্র-সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশকে পৃথক করতে হবে, দেশ জনতাকে একত্রিত করতে হবে। প্রয়োজনে শহীদ হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।১৯৭১ নামক একটি সন এলো বাঙালির উপর। সাথে আবদুল হামিদের উপরও। ১৯৭১ এর মার্চে বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের সময় চট্টগ্রামে শুরু হয় বাঙালি বিহারী দাঙ্গা। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর মদদপুষ্ট হয়ে বিহারীরা বাঙালিদের ঝাঁপিয়ে পড়ে। চট্টগ্রাম ওয়ারলেস কলোনিতে মারাত্মক সংঘর্ষ হয়। তখন কমার্স কলেজ থেকে একটি প্রতিবাদ মিছিল যাচ্ছিল সেদিকে। রক্তপাত এড়ানোর জন্যে সে দিনের মিছিলটি হামিদের পরামর্শেই লালদিঘিতে গিয়ে শেষ হয়। ১৭ ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের নির্দেশ মাথায় ও হৃদয়ে ধারণ করে তিনি (আবদুল হামিদ) চকরিয়ায় এলেন মুক্তিকামী জনতাকে সংঘটিত করতে।

এস. কে শামসুল হুদা ও ডা. শামসুদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত সংগ্রাম কমিটির সাথে একাত্ব হয়ে নিজেকে নিয়োজিত রাখলেন। ২৩ মার্চ সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়। এ উপলক্ষ্যে চকরিয়া বিমানবন্দর ময়দানে স্মরণকালের এক জনসভার আয়োজন করা হয়। জনসভায় চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম আর সিদ্দিকী প্রধান অতিথির ভাষণ দেন। এ সময় জেলা আওয়ামী লীগ নেতা এডভোকেট জহিরুল ইসলাম, মহকুমা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম, কেন্দ্রিয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রিয় সদস্য এএইচ এম সালাহউদ্দিন মাহমুদের পাশাপাশি ছাত্রনেতা আবদুল হামিদও বক্তব্য দেন।
বাংলাকে পাকিস্তান থেকে মুক্ত করতে জনসভা থেকে চকরিয়ায় শত্রুর বিরুদ্ধে যাত্রা শুরু হয়। কালুরঘাট পতনেরর পর ২৭ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ভারী অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে চকরিয়ার সংগ্রামী জনতার প্রতিরোধ ভেদ করে অতর্কিত হামলা চালায় চিরিঙ্গার হিন্দু পাড়ায়। সাথে সাথে এস. কে শামসুল হুদা দেলোয়ার হোসেন, সারদা বাবু এমনি করে প্রত্যেকের ঘরে ঘরে আগুন লাগিয়ে এবং সেইদিন আগুন নেভানোর কাজে সহায়তা করায় আবুল হোসেন, সারদা দাসের ছেলে পরিতোষ চন্দ্র দাস, মনীন্দ্র দাশকে গুলি করে হত্যা করে। শহীদ হাবিলদার আবুল কালামের চাচাত ভাই ছিলেন শহীদ আবুল হোসেন। চকরিয়ার বাটাখালী গ্রামের ইমাম শরীফের পুত্র তিনি। আর শহীদ আবুল কালাম তখন ছাত্র যুবকদের চিরিঙ্গার সামরিক প্রশিণ দিচ্ছিলেন।

পাক হানাদার বাহিনী চকরিয়ায় প্রবেশ করার সাথে পাকি দোসরদের চেহারা সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। প্রথমেই তারা লুট ও যুবতী নারীদের ধরে ধরে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে ভোগের সামগ্রী হিসেবে তুলে দিলো। পিয়ারী মহাজনসহ অনেক হত্যা করতে সহায়তা করল তারা। হাবিলদার আবুল কালামের প্রশিক্ষণে আবদুল হামিদ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যায় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্বে সীমিত শক্তি নিয়ে প্রতিরোধ করেন। অন্য যারা ছিলেন মাহবুব, জহিরুল ইসলাম সিদ্দিকী, নজির আহমদ প্রমূখ। তারা প্রথমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সীমিত শক্তি নিয়ে তাদের প্রতিরোধ করেছিলেন কিন্তু পরে যখন বুঝলেন যে, অত্যাধুনিক অস্ত্রের সামনে টিকে থাকা সম্ভব নয়। তাদের আরো প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র প্রয়োজন। তাই তারা ভারতে গিয়ে গেরিলা প্রশিক্ষণের সিদ্ধান্ত নেয়।
ভারতের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমার আগেই বাড়ি থেকে বিদায় নেওয়ার মুহুর্তে তার অগ্রজ বড় ভাই এজাহার হোসাইনকে বললেন, ‘দাদা আমি তাহলে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণের জ্য ভারতের পথে পাড়ি দিলাম। এখানে কাপুরুষের মতো বসে থাকার অপরাধ কোন দিন ইতিহাস ক্ষমা করবে না। কোন দিন ফিরে এলে দেখা হবে, দোয়া করবেন।’ ১৮সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা ১৮ মে লামা হয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয়। গভীর জঙ্গল অতিক্রম করে পাহাড়ের পর পাহাড় ডিঙ্গিয়ে গাছের ফলমূল কিংবা বুনো মুরগী শিকার তার মাংস আগুনে ঝলসে ক্ষুধা মিটিয়ে প্রায় ১০দিন পর ভারতের মিজারাম প্রদেশের দেমাগিরিতে পৌঁছেন। ভারতের মিজোরাম আবার বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে, পাকিস্তানি মদদপ্রাপ্ত, বাঙালিদের ভয়ানক শত্র“ ভাবাপন্ন ছিলো। বহু বাঙালি তাদের হাতে প্রাণ হারিয়েছে। আবদুল হামিদের দল এমনি দুবার বিপদে পড়ে গিয়েছিলো, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বি এস এফ এর সদস্যরা তাদের রক্ষা করে লংলাইয়ের সামরিক ক্যাম্পে পৌঁছে দেয়। সেখান থেকে মাসাধিক ট্রেনিং নিয়ে আবদুল হামিদের নেতৃত্বে এক দু:সাহসিক যোদ্ধাদল বাংলাদেশের কক্সবাজার মহকুমার চকরিয়ায় ফিরে আসে। এ দলে সেকেন্ড কমান্ড ছিলেন নজির আহমদ। অন্য যারা ছিলেন তাদের মধ্যে জহিরুল ইসলাম সিদ্দিকী (প্রখাত সাহিত্যিক সাংবাদিক মোহাম্মদ আবদুর রশিদ সিদ্দিকীর ছেলে), মোজাম্মেল হক, মোহাম্মদ ইউনুছ, আনোয়ার হোসেন, এনামুল হক (শহীদ), সন্তোষ, সুনীল, বেলাল, অমূল্য, শ্রীমন্ত, অনীল, ধনঞ্জয় দাশ, দুলাল, এস এম কামাল, আবু তাহের, রমজান আলী বাহাদুর, আমির হামজা, শাহাদাৎ হোসেন, নুর হোসেন, সিরাজুল ইসলাম, সাধন, জয়নাল আবেদিন, মোহাম্মদ মুছা, লামার মুছা১৯ (এ মুছার জন্যেই তাকে শহীদ হতে হয়েছে), নুর মোহাম্মদসহ আরো অনেকে।২০ প্রশিক্ষণ শেষে সবাইকে হাবিলদার আবুল কালাম (সশস্ত্রযুদ্ধে শহীদ)সহ কয়েকজন মিলে গেরিলা দলের নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের লামা, আলীকদম ও চকরিয়ার এলাকায় বিভিন্ন কৌশলে হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকারদের উৎখাত করে। এর মধ্যে লামা থানা অপারেশন ও থানার সকল অস্ত্রশস্ত্র হস্তগত করে মুক্তিযুদ্ধে বিরাট সাফল্য লাভ করেন হামিদ এবং আবুল কালামের নেতৃত্বাধিন গেরিলা দল। এরপর হানাদার বাহিনী হামিদের সন্ধানে দেশীয় রাজাকারদের লেলিয়ে দেয়। হামিদের নেতৃত্বে একটি দল যখন চকরিয়ার বিষফোঁড়া গণদুশমণ মেজর জামানকে চরম শাস্তি দেবার লক্ষ্যে উপায় উদ্ভাবন করেছিলেন। হামিদের নেতৃত্বে একটি মুক্তিযোদ্ধা দল যখন জামানের ঘাটি আক্রমণ করার প্রস্তুতির খবর পাকিস্তানি দোসর লামার রাজাকার মুছা হানাদার বাহিনীকে গোপনে খবর দেয়।
৪ নভেম্বর পাকিস্তানি ও জামায়াতের নেতৃত্বে রাজাকার গফুরের দল মুছাসহ অতর্কিত হামিদের বুমার ঘাটি আক্রমণ করে। রাতের অন্ধকারে তাঁর ভাই ও ভগ্নিপতি আজমল হোসেনসহ পাকিস্তানীদের হাতে আক্রমণে আটকা পড়ে যায়। আর হামিদকে রক্ষা করার জন্য স্থানীয় আওয়াীলীগ নেতারা মাতামুহুরী প্রতিরোধ করার প্রত্যয়ে দাঁড়ায় কিন্তু পাকিস্তানী দোসরের সহায়তায় পাকিস্তান বংশোবদ বাঙালি অবসর প্রাপ্ত মেজর জামান কক্সবাজারে পাকিস্তানি সেনা দপ্তরে ওয়ারলেস সংবাদ পাঠায়। পাক হানাদার বাহিনীরা আকাশ বাতাস বিদীর্ণ করে চকরিয়ায় ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে ধোয়ার কুন্ডলী সৃষ্টি করে মাতামুহুরী তীরের জনতাকে আক্রমণ করে ছত্রভঙ্গ করে। আবদুল হামিদকে প্রথমে লামা এবং পরে কক্সবাজারের সেনা ঘাটিতে নিয়ে যায় রাজাকার দল। অতি ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর সেনাবাহিনীর পাঞ্জাবী কমান্ডিং অফিসার ক্যাপ্টেন আসিফ রিজভী ও তার সহযোগী দুর্ধর্ষ হাবিলদার সফদলার আলী আফ্রিদী। তাদের দুই জনের নির্যাতন ও অত্যাচারের প্রক্রিয়া হিটলারের মতন। কক্সবাজার সেনা ঘাটিতে পাক বাহিনীর ক্যাপ্টেন আসিফ রিজভী তাঁর জামার পকেট তল্লসীর উদ্দেশ্যে হাত দিতে উদ্যত হলে তিনি গর্জে উঠে বলেছিলেন, Stop. Do you not know I am a citizen of Bangladeshi? you must be my permission before Charge me” তাঁর উপর অমানুষিক নির্যাতন করেও তার মুখ কোন তথ্য বের করতে পারেনি। আবদুল হামিদ শেষ বারের মত বলেছিলেন ‘আমি বাঙালি, দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে আমি একটি শব্দ উচ্চারণ করবো না। তোমাদের পদানত হতে আমার জন্ম হয়নি। আমি এখন তোমাদের বন্দী, যা খুশী তোমরা করতে পার। আমি কোন কথা বলবোনা, বলনো না’।তাঁর এ নির্ভীক বীরত্বপূর্ণ উচ্চারণ ও আচরণ দেখে রিজভীর মতো নরপশুও মন্তব্য করেছিলেন, হামিদের মতো ছেলে যে দেশে জন্মায় দেশ স্বাধীন না হয়ে যায় না।’’

পরে টেকনাফের বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয় আবদুল হামিদকে। আবদুল হামিদের মুত্যু সম্পর্কে কক্সবাজার শহরের নতুন বাহারছড়ার অধিবাসী আবদুল জলিল (যিনি তখন পাকবাহিনীর সদস্যদের জুতা সেলাই করতেন) বিস্তারিত জানান দেন এক মুক্তিযোদ্ধা-সাংবাদিককে। তার বয়ানের উদ্ধৃতি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন ছাত্রলীগ নেতা ও প্রবীণ সাংবাদিক প্রিয়তোষ পাল পিন্টু লিখেন, পাকবাহিনী আবদুল হামিদকে বারবার নির্দেশ দিয়েছিল ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলতে। উত্তরে তিনি ‘জয়বাংলা’ বলেছিলেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে পাকসেনারা তাঁর বুকে গুলি চালায়।

টেকনাফের বধ্যভুমি থেকে ১৮ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম কমার্স কলেজের ছাত্র আবদুল হামিদের লাশ তাঁর বড় ভাই চকরিয়া জাতীয় মুক্তিফৌজের সক্রিয় সংগঠক বাম তাত্ত্বিক এজাহার হোসাইন সনাক্ত করেন। সনাক্ত পরবর্তী সময়ে শহীদ আবদুল হামিদকে চকরিয়ার কাকারাস্থ শাহ ওমর (রা) দরগাহর পাশে দাপন করা হয়েছে। শহীদ আবদুল হামিদের স্মৃতি রক্ষার্থে চট্টগ্রাম সরকারী কমার্স কলেজে শহীদ আবদুল হামিদ ছাত্রাবাস, কক্সবাজার পাবলিক লাইব্রেরীতে শহীদ আবদুল হামিদ পাঠাগার, চকরিয়া কলেজে শহীদ আবদুল হামিদ ছাত্রাবাস, শিকলকাটা-মানিকপুর ও লামা-বমুবিলছড়ি পর্যন্ত সড়কদ্বয় শহীদ আবদুল হামিদ সড়ক, চকরিয়া শহীদ আবদুল হামিদ উচ্চ বিদ্যালয় এবং চকরিয়ায় শহীদ আবদুল হামিদ প্রাথমিক বিদ্যালয় তার স্মৃতি বহন করে আছে। তাছাড়া অতি সম্প্রতি চকরিয়ার কৃতি পৌর মেয়র জাফর আলমের (বর্তমানে চকরিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান) একান্তিক চেষ্টায় চকরিয়া কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালটি শহীদ আবদুল হামিদ বাস টার্মিনাল নামকরণ করা হয়েছে।


শেয়ার করুন