হুমায়ুন সিকদারঃ
দীর্ঘ ৫ মাস যাবত করোনা মহামারি লকডাউনে বন্ধ থাকার পর ৪ দিন আগে পর্যটন দুয়ার খুলে দেয়ায় ককসবাজার সমুদ্র সৈকতে গতকাল বন্ধ ও বাদলা দিনেও পর্যটকদের ভারে মুখরিত সৈকত।
হোটেল মোটেল ও রেষ্টুরেন্টে পর্যটকদের ভীড় লক্ষ্যণীয়।
কলাতলী,সুগন্ধা পয়েন্ট ও লাবনী পয়েন্টে পর্যটকদের দেখা মেলে। কিটক্যাট ছাতার নীচে বসে সুূর্যাস্ত দেখা ও লাবনী মার্কেটে কেনাকাটায় ব্যস্ত আগত পর্যটকরা।
ককসবাজারে ৪৭০ টি হোটেল – মোটেলের ৩০ হাজার কর্মকর্তা- কর্মচারি ও দেড় শতাধিক ট্যুর অপারেটরসহ দেড় লক্ষাধিক কর্মকর্তা – কর্মচারিগণ পর্যটন শিল্পের দ্বার উন্মোচন হওয়ায় আশান্বিত।
জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেন বলেন, কক্সবাজারের পর্যটন শিল্প ও সংশ্লিষ্ট ব্যবসা বাণিজ্য কঠিন শর্ত সাপেক্ষে খুলে দেওয়া হয়েছে।
গত ১৯ জুলাই আবাসিক হোটেল মোটেলের কর্মকর্তা – কর্মচারিগণ প্রধানমন্ত্রীর কাছে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে পর্যটনের দুয়ার খুলে দেয়ার আবেদন জানান।
আবাসিক হোটেল, রেষ্টুরেন্ট সহ পর্যটন শিল্প সংশ্লিষ্ট যে সকল প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত কোভিড-১৯ সংক্রামন প্রতিরোধ ব্যবস্থা থাকবে এবং স্বাস্থ্য বিধি কঠোরভাবে মেনে চলবে শুধুমাত্র সেসব প্রতিষ্ঠানকে খোলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়।
কোভিড- ১৯ লকডাউনে কক্সবাজারে পর্যটনের সাথে যুক্ত এমন বেকার লক্ষাধিক, ক্ষতি হাজার কোটি টাকা হতে পারে বলে পর্যটন শিল্প সংশ্লিষ্টরা জানান।
দেশের অন্যান্য খাতের মতো পর্যটন খাতেও মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস। গত ৫ মাস ধরে বন্ধ ছিল পর্যটনসহ সব ধরনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।
বিশেষ করে করোনাভাইরাসের প্রভাবে কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পে নেমেছে ধ্বস। গত ৫ মাস যাবত পর্যটকশূন্য হয়ে পড়ে পর্যটন নগরী ককসবাজার। সেই সঙ্গে বন্ধ রয়েছে অন্যান্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। এতে ক্ষতি হয়েছে হাজার কোটি টাকা।
এছাড়া মহামারি পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীদের বাড়ছে ব্যাংক ঋনের ভারে চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে কক্সবাজারে ১৮ মার্চ থেকে পর্যটক আগমন বন্ধ করে দেয়া হয়। গন্তব্যে পৌঁছে দেয়া হয় এখানে অবস্থানরত পর্যটকদের। ধীরে ধীরে জনশূন্য এলাকায় পরিণত হয় পর্যটন নগরী কক্সবাজার। সব ধরনের বাণিজ্য বন্ধ থাকায় চার মাস আয়-রোজগার শূন্যের কোটায়। কোটি কোটি টাকার আবাসন প্রতিষ্ঠান নিয়ে চরম বেকায়দায় ছিল পর্যটন ব্যবসায়ীরা।
পর্যটন ব্যবসা সংশ্লিষ্টরা জানান, জেলার অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়েছে করোনাভাইরাস। পর্যটনের সঙ্গে বার্মিজ, ঝিনুক, রেস্তোরাঁ, শুকনা খাবার, পান-সিগারেটসহ সংশ্লিষ্ট প্রায় অর্ধশত ক্ষুদ্র ব্যবসা ও নানা ধরনের পরিবহন যুক্ত। এসব ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত প্রায় লক্ষাধিক মানুষ।
হোটেল কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ছাড়াও বিদ্যুৎ বিল ও আনুষঙ্গিক খরচ লাখ লাখ টাকার মতো। ব্যবসা বন্ধ থাকায় ঝুঁকি নিয়ে গত ৫ মাস ভাড়া ও অন্য ব্যয় পরিশোধ করতে গিয়ে ধারদেনায় পড়তে হয়েছে ব্যবসায়ীদের।
কক্সবাজার ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের (টুয়াক) সাবেক সভাপতি রেজাউল করিম বলেন, দীর্ঘ ৫ মাস পর্যটন ব্যবসায়ীরা বেকার হয়ে চরম দুর্ভোগে দিনাতিপাত করছে ।
বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা ছাড়াও কুয়াকাটা, প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিনস, বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন, নিঝুম দ্বীপ, চা বাগান, নদী, পাহাড়, হাওর ও পুরাকীর্তিসহ নানা বৈচিত্র্যপূর্ণ পর্যটন আকর্ষণে ভরপুর বাংলাদেশ। এসব পর্যটনকেন্দ্রে প্রতিবছর ভ্রমণ করছে প্রায় ৯০ থেকে ৯৫ লাখ পর্যটক। এর মধ্যে বিদেশি পর্যটক মাত্র ২ শতাংশ। সুযোগ সুবিধাসহ বিভিন্ন কারণে বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে বিশ্বের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর তালিকায় পড়েছে বাংলাদেশ।
মার্কিন উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ভ্রমণে আসা বিদেশি নাগরিকদের সবচেয়ে বড় অংশই আসে তৈরি পোশাক খাতের ব্যাবসায়িক প্রতিনিধি হিসেবে, যা মোট বিদেশির ৪০ শতাংশ। এর পরই রয়েছে উন্নয়ন খাতের বিভিন্ন কাজে আসা বিদেশিরা। মোট বিদেশির মধ্যে এদের হার ২৫ শতাংশ। এ ছাড়া বেসরকারি খাতে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগসংশ্লিষ্ট ও বিভিন্ন দূতাবাসসংশ্লিষ্টরা রয়েছে ১৫ শতাংশ করে। বিদেশিদের মধ্যে বাকি ৫ শতাংশ বাংলাদেশে আসছে প্রকৃত পর্যটক হিসেবে।
বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ড জানায়, চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে (জানুয়ারি-জুলাই) বাংলাদেশ ভ্রমণ করেছে এক লাখ ৮৯ হাজার ৮৮৭ জন বিদেশি। এর মধ্যে প্রকৃত পর্যটক কত তার পরিসংখ্যান নেই। গত বছর বাংলাদেশে ভ্রমণে এসেছিল প্রায় দুই লাখ ৬৮ হাজার বিদেশি। এর আগে ২০১৭ সালেও প্রায় একই সংখ্যক বিদেশির আগমন ঘটে বাংলাদেশে।
এদিকে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ২০১৯ সালের ট্র্যাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কমপিটিটিভনেস রিপোর্টে নিরাপত্তা ও সুরক্ষায় সবচেয়ে বেশি উন্নতির কারণে যদিও পাঁচ ধাপ এগিয়ে ১২৫ থেকে ১২০ নম্বরে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। বিমান পরিবহন অবকাঠামো, নিরাপত্তা, সংস্কৃতি, বাসস্থান, টাকার মান ও স্থিতিশীল ভ্রমণের সুযোগসহ ৯০টি মানদণ্ডের মধ্যে অনুন্নত পর্যটন সেবা অবকাঠামো, বায়ুদূষণ ও জলাবদ্ধতা বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্জনকে ম্রিয়মাণ করেছে। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পর্যটন খাতের কোনো মাস্টারপ্ল্যান বা মহাপরিল্পনা না থাকায় অপরিকল্পিত উন্নয়ন হয়েছে পর্যটনের। এতে আকর্ষণ হারিয়েছে প্রধান পর্যটন গন্তব্যগুলো। এ ছাড়া সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও পর্যটন পণ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা ও বিপণন করতে না পারার কারণে এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে সেভাবে পর্যটক আসছে না।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় আমরা পর্যটন খাতে পিছিয়ে আছি। আমাদের হোটেলগুলোর এখনো সঠিকভাবে স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণ করা যায়নি। অনেকে টু স্টার মানের না হলেও ফাইভ স্টার হিসেবে কার্যক্রম চালাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তদারকি বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে পর্যটকদের আরো ভালো সেবা দেওয়ার জন্য যেসব সুযোগ-সুবিধা দরকার, যেগুলো অন্যান্য দেশে আছে তা নিশ্চিত করতে হবে।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, পর্যটন উন্নয়নে আমাদের কোনো মাস্টারপ্ল্যান না থাকায় এই খাতের পরিকল্পিত অবকাঠামো গড়ে উঠছে না। ফলে পর্যটন খাত কার্যত ছন্দহীন। এ ছাড়া জাতীয় পর্যটন কাউন্সিলে বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিত্ব না থাকায় এবং কাউন্সিলের নিয়মিত সভা ও তদারকি না থাকায় এই খাতের স্থবিরতা কাটছে না। প্রতিটি দেশের পর্যটনের উন্নয়নে জাতীয় পতাকাবাহী বিমান সংস্থার যে ভূমিকা থাকে আমাদের দেশে বিমানের ক্ষেত্রে তা একেবারেই অনুপস্থিত।’
ট্যুর সংশ্লিষ্টরা জানান, ‘২০১৬ সালে স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতো তিন বছরব্যাপী (২০১৬-১৮) পর্যটন বর্ষ ঘোষণা করা হলো।
ট্যুর অপারেটরস অব বাংলাদেশ (টোয়াব)- নেতারা জানান,
আমাদের ইনবাউন্ড ট্যুরিজমের কী দুরবস্থা সে সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের সুনজর প্রয়োজন।
পর্যটন খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘সব ধরনের উন্নয়নে পর্যটন খাতকে সম্পৃক্ত বা মাথায় রাখতে হবে।
খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, জিডিপিতে পর্যটনের অবদান ২ শতাংশ ছাড়িয়েছে। তবে ভালো হোটেল, দক্ষ ও মানসম্মত সেবার অভাব, বিদেশি পর্যটকদের জন্য বিনোদনের অভাব, নিরাপত্তাহীনতা, যোগাযোগ ও যাতায়াত সমস্যা, অবকাঠামোগত দুর্বলতা এবং সরকারের সুনজর ও পরিকল্পনার অভাবে এ খাতের সম্ভাবনা নষ্ট হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক জরিপে দেখা গেছে, অর্থনীতিতে পর্যটন খাতের অবদান ১৬ হাজার কোটি টাকা। প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যায় ১৫ লাখ। তবে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে পর্যটন আগমনের ওপর বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের (বিটিবি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিদেশি পর্যটকদের ২৫ শতাংশই যায় সিলেট ও শ্রীমঙ্গলে। এ ছাড়া ২৩ শতাংশ কক্সবাজার, ১৭ শতাংশ পার্বত্য জেলা, ১০ শতাংশ সুন্দরবন, ৭ শতাংশ সেন্ট মার্টিনস, বাগেরহাটে ৬ শতাংশ এবং বিভিন্ন পুরাকীর্তি দেখতে ২ শতাংশ পর্যটক উত্তরবঙ্গ অঞ্চলে ভ্রমণ করে।