সিটিএন ডেস্কঃ
‘করোনা কোন সাধারণ রোগ না, এইটা আগেকার দিনের কলেরা, বসন্তের মতোই মহামারী। এইটা একটা দুষ্ট দানব। এটা এমনিতেই যাবে না। একে তাড়াতে হবে।’ তাই এমন বিশ্বাস কিংবা কুসংস্কার থেকেই রাতের আধারে দেয়া হয় “কবুতর চালান” (মন্ত্র পড়ে কবুতর ছেড়ে দেয়া হয়)। আর সাথে সাথে ভাঙা টিন, হাড়ি পাতিল, থালা, প্লাষ্টিকের ক্যান্টি যে যা পারেন ঢোলের মতো পিটিয়ে শব্দ করে এবং আদিম কোন জাতির ন্যায় মুখে উচ্চ স্বরে আওয়াজ তুলে করোনা তাড়াতে অংশ নিয়েছেন কয়েক লাখ মানুষ।
এমন ঘটনা ঘটেছে সোমবার (৫ এপ্রিল) রাতে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা, ফুলবাড়িয়া ও মধুপুর উপজেলায়। ফুলবাড়িয়া থেকে শুরু হওয়া এর প্রভাবে বুঝে না বুঝে থালা, বাটি, হাড়িপাতিল, টিন নিয়ে অদ্ভুত যজ্ঞে অংশ নিয়েছেন ফুলবাড়িয়া উপজেলার একটি পৌরসভা, ১১টি ইউনিয়নের সাথে সাথে পাশ্ববর্তী মুক্তাগাছা, মধুপুর ও ত্রিশাল উপজেলার কয়েকটি গ্রামের লোকজন।
খোঁজ নিয়ে জানাযায়, রাত সাড়ে ৮টা- ৯টার দিকে ফুলবাড়িয়া উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে হঠাৎ করেই হই হই রব এবং ঢাক-ঢোল পেটানো শব্দ শুরু হয়। এভাবে সারা উপজেলা জুড়েই শব্দ চলতে থাকে। বলা হয় কইতর চালনা দেয়া হয়েছে(কবুতর ছেড়ে দেয়া হয়েছে।) এই কবুতর যাদের বাড়ির চালে বসবে সেখানেই মরকব্যাধী করোনা বাসা বাঁধবে। এমন সংস্কারে বিভিন্ন গ্রামের ছেলে-বুড়ো, নারী-পুরুষ লাখ লাখ মানুষ ঘর থেকে মুড়ির টিন, ভাঙা টিন, ক্যান্টি, টিন বা কাসার থালা, স্কুলের ঘন্ট, ঢোল, পাতিল, হাড়ি যে যা পারেন নানা কিছু নিয়ে কাটি দিয়ে পিটিয়ে শব্দ করতে থাকেন। এভাবে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে বিস্তৃতি লাভ করতে করতে সারা উপজেলায় এমনকি পাশের উপজেলাগুলোর বিভিন্ন গ্রামে কয়েক ঘন্ট ব্যাপী এমন কান্ড ঘটে। এ সময় লোকজন বলতে থাকে ‘করোনা দূরে যা, করোনা দূরে যা।
ফুলবাড়িয়ার পীড়গঞ্জ বাজার এলাকার বৃদ্ধ মমতাজ আলী বলেন, আমরা অনেক ছোট থাকতে দেখতাম কলেরা বা বসন্ত রোগের মহামারির সময় বৈদ্য, কবিরাজরা রাতের বেলায় মন্ত্র পড়ে কবুতর উড়িয়ে দিত। একে কবুতর চালান দেয়া বলা হত। তখন সবাই মিলে নানা কিছু পিটিয়ে শব্দ করে এই কবুতরকে তাড়ানো হত। বলা হত এই কবুতর যত দূরে যাবে কলেরা বা বসন্তরোগও তত দূরে চলে যাবে। এবং যাদের বাড়িতে এই কবুতর বসতে তাদের বাড়িতেই এই রোগে সবাই উজার হবে। এটা মূলত অজ্ঞ মানুষ জনের অন্ধ বিশ্বাস থেকেই হত। তিনি বলেন দীর্ঘদিন পড়ে করোনা ভাইরাস তাড়াতে এমন ঘটনার সূত্রপাত হল। তিনি নিজে এতে বিশ্বাস করেন না উল্লেখা করে বলেন, অসহায় অবস্থায় মানুষ নানা কিছুই করেন।
কদমতলী গ্রামে আক্কাস আলী বলেন, এত শব্দ শুনে প্রথমে আমি ভয় পেয়ে যাই। পড়ে আমরা নিজেরাও অনুরোপ শব্দ করেছি।
কইয়ের চালা গ্রামের ছমিরন বেওয়া বলেন, ঘটনা সত্য। উলাউঠার মত করেই মহামারী তাড়াতে এমন করা হয়। এই বার যে মহামারী আসতেছে তা থেকে মুক্তি পেতেই মানুষ জন এমনটা করেছে। শব্দ না করলে এই রোগ যাইবো না। শব্দ কইরাই তাড়াইতে অইবো।
বাগতা ইউপি চেয়ারম্যান ফজলুল হক মাখন বলেন, রাত ৯টার দিকে হঠাৎ এমন শব্দের থমকে যাই। পড়ে বুঝতে পারে ঘটনাটা কি। তিনি বলেন, এটা অনেক প্রাচীন একটি কুসংস্কার। এতে করে করোনা বা কোন মহামারী তাড়ানো সম্ভব না। তবুও লৌকিক বিশ্বাস থেকে মানুষ এমনটি করে থাকে। এমন অদ্ভুত কর্মে অতীষ্ঠ হয়ে অনেকেই রাতে বেলায় মসজিদে গিয়ে এসব থামানোর ঘোষনা দিয়ে সচেতনতামূলক কথা বার্তা বলেন।
মুক্তাগাছার বটতলা গ্রামের প্রবীন রাজনীতিক এসএম আবু সাঈদ বলেন, শব্দটা ফুলবাড়িয়ার দিক থেকে এসেছে। রাত সাড়ে দশটার দিকে আমাদের এলাকাতেও মানুষ এমন অদ্ভুত কর্মকান্ড শুরু করলে আমরা বাদ্য হয়ে মসজিদের মাইকে মানুষকে সচেতন হবার ঘোষনা দিতে থাকি। এক পর্যায়ে বিভিন্ন মসজিদে ঘোষণা শুরু হলে এই এলাকাতেই ঘটনাটি থেমে যায়।
এ নিয়ে রাত থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে শত শত পোস্ট দেখা যায়। সেখানে নানা জন নানা মন্তব্য করেন। সাইফুল ইসলাম তরফদার নামে স্থানীয় একজন সাংবাদিক তার ফেসবুক ওয়ালে পোস্টে লেখেন, আগে কলেরা তাড়াত এবার করোনা ভাইরাস তাড়াতে টিন, থালা পেটাল মানুষ। সোমবার রাতে এমন ঘটনা ঘটিয়েছে ফুলবাড়িয়া পৌরসভাসহ ১৩টি ইউনিয়নের মানুষ।
তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, প্রথম বিষয়টি না বুঝতে পেরে হতভম্ব হয়ে গিয়ে অন্যান্যের মত আমিও একটি লাঠি নিয়ে পাশের টিনের বেড়ায় পেটাতে থাকি। পড়ে অবশ্য বুঝতে পেরে নিজে নিজেই লজ্জিত হই। এদিকে কুসংস্কারের পাশাপাশি সচেতনতার অংশ হিসেবে, মঙ্গলবার সকাল থেকেই ফুলবাড়িয়া উপজেলার দেওখোলা বাজারে স্থানীয়রা উদ্যোগী হয়ে স্বেচ্ছায় লকডাউনের ব্যবস্থা করেন। একই অবস্থা চলে ময়মনসিংহ সদরের কুষ্টিয়া ও মুক্তাগাছার চড়াঘাটি ব্রীজ এলাকায়। এসব স্থানে প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় সচেতন লোকজন সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়ে এগিয়ে আসছে।
ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মো. মিজানুর রহমান জনগণের স্বেচ্ছায় লকডাউনের মত ব্যবস্থা নেয়াকে স্বাগত জানিয়ে ফেসবুক ওয়ালে রাস্তায় প্রতিবন্ধিকতার ছবি দিয়ে লিখেছেন, এ ধরণের উদ্যোগ ছড়িয়ে পড়ছে জেলার সর্বত্র। আমরা সকলের সহায়তা চাই।