জেলার উপকুল রক্ষায় প্রয়োজন সবুজ বনায়ন ও টেকসই বেড়িবাঁধ

হুমায়ুন সিকদার

উপকুল বাঁচলে দেশ বাঁচবে;
এশ্লোগানে জেলার উপকুলীয় এলাকা রক্ষায় প্রয়োজন সবুজ বনায়ন ও টেকসই বেড়িবাঁধ।
জানা যায়, ১৯৯১ সালে ২৯ এপ্রিল প্রলয়ংকরী ঘুর্ণিঝড়ে লন্ডভন্ড হয়েছিলো উপকুল। যার ক্ষত এখনো শুকায়নি।
নেই টেকসই বেড়িবাঁধ
আছে বেড়িবাঁধের বাইরে শত শত অসহায় পরিবারের বসবাস।
জেলার দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়া, মহেশখালীর ধলঘাটা, মাতারবাড়ি, পেকুয়ার মগনামা, রাজাখালী ও উজানটিয়া, চকোরিয়ার বদরখালী, সদরের খুরুশকুল, চৌফলদন্ডী, বাঁকখালী এলাকা ও নাজিরারটেক, উখিয়ার সোনারপাড়া, ইনানী, টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ ও সেন্টমার্টিন উপকূলীয় এলাকাসমুহের ৩ শ কিমি এখনো অরক্ষিত সুত্র জানায়।
বর্ষা মৌসুম আসলে তারা আতংকে থাকে। জোয়ারের পানিতে একাকার হয়ে যায় উপকুলবাসী। বর্তমান সরকার উপকুলীয় এলাকা রক্ষায় বেড়িবাঁধ নির্মাণ শুরু করে দিয়েছে।
জলবায়ু কল্যাণ তহবিল থেকে উপকুলের জীবনমান ও রক্ষা করা যেতে পারে বলে উপকূল গবেষকরা মনে করেন।
Intergovernment Panel on Climate Change (IPCC)-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী উষ্ণায়ন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে চলা, আবহাওয়ার উপাদানগুলোর পরিবর্তন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় বিশ্বের যে ক’টি দেশের পরিবেশ বিপর্যয়সহ জনমানুষের জীবন ও জীবিকা বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, তন্মধ্যে বাংলাদেশ, বিশেষ করে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল অন্যতম।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ১৯টি উপকূলীয় জেলা। এ ১৯টি জেলার ১৪৭টি উপজেলায় দেশের মোট জনসংখ্যা এক-চতুর্থাংশের বেশি মানুষ বসবাস করে। ইতোমধ্যেই উপকূলীয় অঞ্চলসহ বাংলাদেশের সর্বত্র জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব লক্ষণীয়। ঘন ঘন ভূমিকম্প, আকস্মিক বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের প্রবণতা বেড়ে যাওয়া, জোয়ারের দীর্ঘস্থায়িত্ব, মাটি ও পানিতে লবণাক্ততা, সুন্দরবনে সুন্দরী গাছের মড়ক ইত্যাদি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত লক্ষণ মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

উপকূলবাসীর জীবনমান অনুন্নত।
বাংলাদেশের এক-দশমাংশ এলাকা উপকূল। এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বসবাস করে গড়ে ৭৪৩ জন মানুষ।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০ বছরে অন্তত ৬৪ বার মনে রাখার মতো বড় ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হেনেছে। ফলে কুতুবদিয়া-মহেশখালীসহ সমুদ্র উপকূলে জনগণকে প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক প্রতিকূল পরিবেশের সাথে সংগ্রাম করে জীবন যাপন করতে হচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ নিজেদের জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি দেশের উৎপাদন ও অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। উপকূলের বেশির ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করলেও শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাদের মধ্যে রয়েছে বেকারত্ব, পুষ্টিহীনতা, নিরাপদ পানি, পুঁজির তীব্র অভাব ও কৃষি পণ্যের বাজারজাতকরণসহ নানা ধরনের সমস্যা। কিন্তু তাদের জীবনের গতি থেমে থাকে না, বাঁচার তাগিদে উপার্জনের পেছনে ছুটে চলে।
তবুও উপকূলের লড়াকু মানুষেরা প্রাকৃতিক দুর্যোগকে মোকাবেলা করেই সাহসের সাথে বেঁচে আছে এবং যুগ যুগ ধরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করে আসছে।
উপকুলীয় এলাকার জন্য বিশেষ বরাদ্দ যেমন প্রয়োজন তেমনি উপকূলীয় উন্নয়ন বোর্ড গঠন ও সময়ের দাবীতে পরিনত হয়েছে।

রয়েছে উপকূলীয় অঞ্চলের সম্পদ-সম্ভাবনা
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল তেল-গ্যাস, গন্ধকসহ ইত্যাদি প্রাকৃতিক ও খনিজসম্পদে ভরপুর। নীতিমালা ও পরিকল্পনার অভাবে এ সম্পদ আহরণ ও ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ থাকে না। ফলে এ সম্পদ গোটা দেশের এবং বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলের দরিদ্র ও বঞ্চিত মানুষের কোনো কাজেই আসছে না। এ সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন প্রয়োজন। পর্যাপ্ত সরকারি বাজেট বরাদ্দ প্রদান করা হলে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবন জীবিকার মানোন্নয়নের সাথে সাথে জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে উপকূলীয় অঞ্চল ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে এ অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগনোর লক্ষ্যে উপকূলীয় এলাকার সম্ভাবনা সম্পদ ভূমিকা রাখতে পারে।
১. সমুদ্র উপকূল এলাকার লবণ একটি অন্যতম শিল্প। হাজার হাজার পরিবার এ শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত। সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা ও নীতিমালার অভাবে এ শিল্প আজ ধ্বংসের মুখে। লবণচাষিরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত। লাভ তো দূরের বিষয় উৎপাদন খরচও তারা পায় না। তা ছাড়া লবণচাষিরা পুঁজির জন্য স্থানীয় দাদন ব্যবসায়ী ও মহাজনদের কাছে বন্দী। আমদানি বন্ধ হলে চাষিরা লবণ উৎপাদন ও ন্যায্যমুল্যে পাবে এবং লবণের জন্য সম্পূর্ণভাবে বিদেশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হবেনা।
পর্যটন শিল্পে ও অবদান রাখছে উপকূলের জনপদ।
২. মাছ উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য আরেকটি অর্থকরী সম্পদ। দেশের মাছের চাহিদা পূরণের জন্য সামদ্রিক মাছের কোনো বিকল্প নেই। চিংড়ি দেশের রফতানি আয়ের দ্বিতীয় উৎস। হোয়াইট গোল্ড নামে খ্যাত চিংড়ি চাষ ও রফতানিতে সরকারের সুষ্ঠু পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন। চিংড়ি চাষ উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণা ব্যবস্থাসহ চিংড়ির খাদ্য হিসেবে প্রাথমিক পর্যায়ে প্রয়োজনীয় আরটিমিয়া আমদানির বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে স্থানীয়ভাবে লবণ মাঠগুলোতে তা চাষ করার জন্য গবেষণা কার্যক্রম হাতে নেয়া যেতে পারে। এ বিষয়ে সরকারের পৃষ্ঠাপোষকতা আবশ্যক।
৩. উপকূলীয় অঞ্চলে শুঁটকি, পান, ধান, বৃক্ষসহ অসংখ্য অর্থকরী ফসল ও সম্পদ রয়েছে; যার উন্নয়নের জন্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট সবার উদ্যোগসহ বাস্তবমুখী পদক্ষেপ প্রয়োজন। কুতুবদিয়া, নাজিরারটেক, সোনাদিয়া ও টেকনাফে বঙ্গোপসাগরের আহরিত মাছের প্রায় ৩০ শতাংশ শুঁটকিতে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। দেশের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বিদেশে শুঁটকি রফতানি করে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা হচ্ছে। এ ছাড়া মহেশখালীর মিষ্টি পান খুবই জনপ্রিয়।

৪. বিদ্যুৎ হচ্ছে উন্নয়নের চালিকাশক্তি। উপকূলীয় অঞ্চল বিশেষ করে দ্বীপ অঞ্চলের মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। বিশাল সম্ভাবনাময় বায়ুবিদ্যুৎ দেশে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে। কুতুবদিয়ায় সাব মেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সংযোগ হতে যাচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশের পুরো উপকূলে বিপুল পরিমাণ বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদ সম্ভব। বায়ুবিদ্যুতের পাশাপাশি মহেশখালী-কুতুবদিয়াসহ উপকূলীয় অঞ্চলে টাইডাল বিদ্যুৎ, বায়ু-গ্যাসবিদ্যুৎ এবং সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে বলে ও বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
৫.. ভোলা, মহেশখালী ও কুতুবদিয়াসহ বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে তেল-গ্যাসসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক ও খনিজসম্পদ রয়েছে। যেমন- ১৯৭৭ সালে কুতুবদিয়ায় একটি গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়, যার মজুদের পরিমাণ ১০০০ ট্রিলিয়ন ঘন ফুট বলে এক জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে। কুতুবদিয়া ও মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপের পশ্চিমে সৈকত বালিতে জিরকন, ইলমেনাইট, ম্যাগনেটাইট, কয়নাইট ও মোনাজাইটের মতো মূল্যবান খনিজ পদার্থ আছে। তা ছাড়া কুতুবদিয়া দ্বীপে গন্ধকের খনি পাওয়া গেছে। এই গন্ধকসহ প্রাকৃতিক ও খনিজসম্পদ যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার মাধ্যমে উত্তোলন করা হলে দেশের অর্থনীতি আরো সমৃদ্ধি লাভ করবে। উপকুলীয় মহেশখালীতে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও গভীর সমুদ্র বন্দর হচ্ছে।
৬. বাংলাদেশের সুন্দরবন ও মহেশখালী-কুতুবদিয়াসহ সমগ্র উপকূলব্যাপী বিস্তৃত এলাকাজুড়ে যে প্যারাবন (ম্যানগ্রুভ) রয়েছে তা উপকূল রক্ষা ও পরিবেশ সংরক্ষণে বড় ধরনের অবদান রাখছে। এ ছাড়া জ্বালানি, গৃহনির্মাণ, উপকূলীয় বাঁধ রক্ষা, পলি জমা, ঘুনিঝড় ঠেকানোসহসহ প্রভৃতি কাজে ওই বনের ভূমিকা অপরিসীম।


শেয়ার করুন