করোনা উপেক্ষা করে কক্সবাজারে লাখো পর্যটক

ইসলাম মাহমুদঃ

করোনা উপেক্ষা করে কক্সবাজারে লাখো পর্যটকের সমাগম ঘটেছ । শুক্রুবার ও গতকাল শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি এবং রবিবার মহান শহিদ দিবস নিয়ে টানা তিনদিনের ছুটির সুযোগে কয়েক লাখ পর্যটক কক্সবাজার সৈকতে এসে ভীড় জমিয়েছেন। দীর্ঘ কালীন সময় ধরে কভিড-১৯ এর কারণে ঘরবন্দি মানুষ করোনা ভীতি কাটিয়ে শীত মৌসুমের শেষ দিকে টানা ছুটি পেয়ে ভীড় জমিয়েছে সৈকতে। স্থানীয়দের ধারণা কমপক্ষে ৩ লক্ষাধিক পর্যটক একদিনে এসে ভীড় করছে কক্সবাজারে। আগামী দুইদিনে এ সংখ্যা দ্বিগুণে দাঁড়াবে বলে মনে করছে পর্যটন ব্যবসায়ীরা।

এদিকে পর্যটক সমাগমের কারনে শহর সহ সৈকতে নিরাপত্তা বৃদ্ধি করেছে ট্যুরিষ্ট পুলিশ ও জেলা পুলিশ। কক্সবাজার ট্যুরিষ্ট পুলিশের পরিদর্শক সাকের আহমদ জানান-‘ ট্যুরিষ্ট পুলিশের ৮০ জন সদস্য আজ (শুক্রুবার) সকাল থেকে সৈকতে ডিউটি করছেন। এই ৮০ জন ১৭ ভাগে ভাগ হয়েই নেমেছেন হোটেল-মোটেল জোন থেকে সৈকত পর্যন্ত। অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছে যে, আমাদের ডিউটিরত সদস্যরাও পর্যন্ত ভীড়ের কারণে এক স্থানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না।’

ট্যুরিষ্ট পুলিশের পরিদর্শক জানান, সৈকতে তিল ধারণের জায়গাও নেই। এত বিপুল সংখ্যক ভ্রমণকারি গত ৫ বছরের সময়েও এক সাথে ভীড় জমাননি। কক্সবাজার হোটেল-মোটেল গেষ্ট হাউজ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম বলেন-‘ আজ শুক্রবার একদিনেই কমপক্ষে তিন লক্ষাধিক পর্যটকের সমাগম ঘটেছে কক্সবাজারে। কক্সবাজারের সাড়ে চার শতাধিক হোটেলে দুই লক্ষাধিক অতিথি থাকতে পারেন। বাদবাকিদের একটু কষ্ট করে রাত অতিবাহিত করতে হবে।’
তবে তিনি মৌসুমগত কারনে পর্যটকদের তেমন দুর্ভোগে পড়তে হবে না জানালেও বাস্তবে দেখা গেছে, অনেক ভ্রমণকারি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন রাত কাটানোর একটি কক্ষের জন্য। সাগর পাড়ের হোটেল-মোটেলে সিট না পেয়ে শহরের ঘিঞ্জি এলাকার নিন্মমানের আবাসিক হোটেলের রুম পর্যন্ত বাড়তি ভাড়ায় পর্যটকরা ভাড়া নিয়ে রাত পোহাতে আশ্রয় নিয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৬ সালের কোন একটি বিশেষ দিনেও এরকম কয়েক লাখ লোক সমবেত হয়েছিলেন কক্সবাজারে। এবারও অনুরুপ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। যেসব ভ্রমণকারি আগে ভাগেই হোটেলের রুম বুকিং করে এসেছেন তারা কোন রকমে ভাল রয়েছেন। কিন্তু যারা আগাম রুম ভাড়া নিয়ে আসেননি তাদের দুর্ভোগ বেড়েছে। শহরের হোটেল-মোটেল ও কটেজ জোনে কোন রুম খালি নেই। এমনকি হোটেলের পরিত্যক্ত রুম পর্যন্ত ভাড়া হয়ে গেছে।

কটেজ জোনের নকশিকাঁথা নামের একটি কটেজের রিসিপশন রুম পর্যন্ত ভাড়া হয়ে গেছে। সেখানে পাতানো হয়েছে গণবিছানা। একটি রুমে ১৫ জন রাত কাটাতে ভাড়া নিয়েছেন ৯ হাজার টাকায়। অনুরুপ ওই এলাকায় ক্ষুদ্র ব্যবসার দোকানগুলোতে চৌকি বসিয়েও ভাড়া দেওয়া হয়েছে। লাইট হাউজ, সৈকত আবাসিক এলাকা ও কলাতলি সহ আশেপাশের এলাকার বাসা বাড়ীর কক্ষও ভাড়া দেওয়া হয়েছে। অনেকেই থাকার জায়গা না পেয়ে রাস্তায় নতুবা গাড়িতে রাত কাটানোরও পরিকল্পনা করছেন।
তবে ভাগ্য ভালো বর্তমানের মৌসুমটি এমন যে, অতি শীত যেমনি নেই তেমনি গরমও নেই। অনেকেই দুইদিন থাকার পরিকল্পনা করে এসেও রাতেই কক্সবাজারের সাগর পর্যটন ছেড়ে নিজ বাড়ী ছুটছেন নতুবা যাচ্ছেন বান্দরবানের পাহাড়ি পর্যটন এলাকা উপভোগ করার জন্য। তবে শনিবার নতুন করে আরো পর্যটকের ভীড় হবে সৈকতে।বৃহষ্পতিবার সন্ধ্যা থেকেই গাড়িতে গাড়িতে পর্যটকের দল কক্সবাজারে আসতে শুরু করে। বৃহষ্পতিবার রাতে রাজধানী ঢাকা সহ দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছেড়ে আসা কয়েকশ নৈশ কোচ শুক্রুবার সকালে এসে পৌঁছে কক্সবাজারে। এ কারনে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে অসহনীয় জ্যাম লেগে যায়। এক সাথে প্রচুর সংখ্যক যান বাহন আসায় কক্সবাজার শহরের কয়েক কিলোমিটার দুরে থামিয়েই যাত্রীদের নামিয়ে দিতে হচ্ছে। এতে করে পর্যটকদের দুর্ভোগেরও শেষ নেই।

শুক্রবার সকাল থেকে দলে দলে পর্যটকরা নামেন কক্সবাজার সৈকতের বালিয়াড়িতে। দুপুর হতে না হতেই সৈকতের ডায়াবেটিক পয়েন্ট থেকে কলাতলি পর্যন্ত ৪ কিলোমিটার এলাকা ভরে যায় মানুষে মানুষে। এ ছাড়াও হিমছড়ি, ইনানী পাথুরে সৈকত থেকে শফির বিল, পাটুয়ারটেক, মনখালী এবং টেকনাফ সৈকত পর্যন্ত প্রচুর সংখ্যক ভ্রমণকারির মিলন মেলায় পরিণত হয়। পটুয়াখালী থেকে শাকিল দম্পতি প্রথম বার এসেছেন কক্সবাজরে। তিনি জানান-‘ এই প্রথমবার এসে কক্সবাজারকে দেখলাম। এত বিপুল সংখ্যক মানুষ আর দেখিনি। সৈকতে এত বেশী মানুষ দেখে মনে হচ্ছে এটা ঢেউয়ের সাগর নয় যেন মানুষের সাগর।’ সিলেট থেকে আসা রিদুয়ানুল কবির জানান‘ এতদিন করোনার কারণে ঘরে বন্দি জীবন কাটিয়েছি। সাগর পাড়ে এসে মনে হচ্ছে, এখন আমরা মুক্ত পাখীর মত উড়ছি আর ঘুরছি।’

পর্যটন ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, করোনার পর থেকেই দেশের নানা প্রান্ত থেকে কোন শিক্ষা ট্যুরে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ভীড় হয়নি। কক্সবাজারে আসেনি এবার কোন কর্পোরেট পিকনিক দল। দেশে করোনার সংক্রমণ হ্রাস পাওয়ায় মানুষের মধ্যে করোনা ভীতি কেটেছে। সেই সাথে ভ্যাকসিন আসার পর সাহস বেড়েছে করোনা ভীতিতে কাতর লোকজনের মধ্যে। এসব কারনে মৌসুমের শেষ দিকের তিন দিনের ছুটিতে এভাবে লোকজন বেড়াতে ছুটে চলা।
কক্সবাজারে এত বিপুল সংখ্যক পর্যটক এসে ভীড় জমিয়েছেন যে, ছোট্ট শহরটির সাড়ে চার শতাধিক হোটেল-মোটেল ও কটেজে তিল ধারণেরও জায়গা নেই। স্থানীয়রা বলছেন, গত কয়েক বছরের মধ্যে রেকর্ড সংখ্যক পর্যটকের সমাগম ঘটেছে কক্সবাজারে। কক্সবাজারে আসা-যাওয়ার যানবাহন ও বিমানেও গত সপ্তাহ থেকে শুরু করে আগামী এক সপ্তাহ পর্যন্ত কোন টিকেটই মিলছে না।এদিকে কক্সবাজার সৈকত ছেড়ে ভ্রমণকারিরা পর্যটক জাহাজে চড়ে ছুটছেন প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন্স। কক্সবাজার থেকে একটি এবং টেকনাফ থেকে আরো ৭ টি পর্যটক জাহাজ সহ সবগুলো জাহাজ ও ইঞ্জিন চালিত নৌকা এবং স্পীড বোটে করে একদিনে কমপক্ষে ১০ হাজার পর্যটক দ্বীপে ভ্রমণে গেছেন। এছাড়াও কক্সবাজারের ডুলাহাজারার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক, মহেশখালী, সোনাদিয়া, মাতারবাড়ি ও কুতুবদিয়া সহ আরো অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্রগুলোতেও ভীড় করছেন পর্যটকরা।


শেয়ার করুন