আসনে নজর ঐক্যফ্রন্টের, বণ্টনের চ্যালেঞ্জ বিএনপির

১০ বছর পর নির্বাচনে আসছে বিএনপিসহ দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর একটি বড় অংশ। নানা জল্পনা-কল্পনা শেষে রবিবার (১১ নভেম্বর) বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। একইসঙ্গে নির্বাচন কমিশনেও বিএনপিসহ নিবন্ধিত শরিক দলগুলো ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে চিঠি দিয়েছে।
নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তের পর এখন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নজর সংসদীয় আসনের ওপর। ঐক্যফ্রন্টের শরিক পাঁচটি দলের চারটি দলই নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা সেরে দলীয় চাহিদাপত্র তুলে দেবে বিএনপির হাতে। একইসঙ্গে ২০ দলীয় জোটের ২২টি শরিক দলও দেবে তাদের প্রস্তাব। সব মিলিয়ে বিএনপির সামনে এখন আসন বণ্টনের চ্যালেঞ্জ।
জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর বিএনপির দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ সহযোগীদের মধ্যে আসন বণ্টন এবং শরিকদের চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তিনশ আসনে প্রার্থী নির্ধারণ করা। ইতোমধ্যে মনোনয়ন সমন্বয় কমিটির প্রধান হিসেবে স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি ২০০৮ এবং ২০০১ সালের নির্বাচনেও সমন্বয়ক ছিলেন।
স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য জানান, রবিবার (১১ নভেম্বর) রাতেই স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্য আসন বণ্টনের কৌশল নিয়ে বৈঠক করবেন। এই বৈঠকেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে কোন কোন প্রক্রিয়ায় জোট ও ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে আসন বণ্টন করা হবে।
বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, নির্বাচনে প্রার্থী নির্ধারণে জোট ও ঐক্যফ্রন্টের শরিকদের চাহিদার বাইরেও দলীয়ভাবে চমক দেওয়া হবে। সবকিছুই খোলাসা হবে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে কারাবন্দি খালেদা জিয়ার সাক্ষাতের পর। আজকালের মধ্যেই তিনি বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে কথা বলে মনোনয়নের বিষয়ে চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা দেবেন। প্রার্থী বাছাই, ঐক্যফ্রন্ট ও জোটের সঙ্গে দরকষাকষি, তারকা প্রার্থী নির্ধারণ এবং গুরুত্বপূর্ণ আসনে জোটের প্রার্থী কে হবেন, এ নিয়ে খালেদা জিয়ার সরাসরি নির্দেশনা নিয়ে আসবেন মির্জা ফখরুল। তার সঙ্গে স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্যও যেতে পারেন খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে।

বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের বৈঠকভোট জোটগতভাবে করলেও ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের শরিকরা ধানের শীষ বা দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করবে। এ নিয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে আগামী বৈঠকে। জোট ও ঐক্যফ্রন্টের বৈঠক খুব দ্রুত অনুষ্ঠিত হবে। তবে নিবন্ধিত প্রায় প্রত্যেক দলই এ সিদ্ধান্ত নিতে সময় নেবে। বিশেষ করে দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি করার পরই এ সিদ্ধান্ত জানাবে দলগুলো।
ঐক্যফ্রন্টের শরিক কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ ইকবাল সিদ্দিকী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা নির্বাচনে জোটগতভাবে অংশগ্রহণ করবো। প্রতীক দলীয়ই থাকবে। তবে দল ও জোট কোনও প্রতীকে সর্বসম্মতভাবে একমত হলে সেই প্রতীক নিয়েই নির্বাচনে প্রার্থিতা করবেন আমাদের প্রার্থীরা।’
রবিবার (১১ নভেম্বর) দুপুরে নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়েছে জোটের শরিক লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি)। দলটির চেয়ারম্যান অলি আহমেদের স্বাক্ষরিত এ চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘তাদের দলের কিছু প্রার্থী দলীয় প্রতীক ছাতা এবং কিছু প্রার্থী বিএনপির প্রতীক ধানের শীষে নির্বাচন করবেন। চিঠিতে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।’
খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা ধানের শীষ ও দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করার সম্ভাবনা জানিয়ে ইসিতে চিঠি দেবো। তবে চূড়ান্তভাবে কোন প্রতীক থাকবে, তা নির্ধারণ হবে জোটের বৈঠকে।’
২০ দলীয় জোটের মধ্যে আসন নিয়ে আলোচনা থাকলেও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে এখনও এ বিষয়টি তোলা হয়নি। পরের বৈঠকেই আসনের বিষয়ে আলোচনা করবে ঐক্যফ্রন্ট। তবে ২০ দলীয় জোটের ক্ষেত্রে শরিকদের আসনকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা আরও আগেই শুরু হয়েছে। জোটের শরিকদের ক্ষেত্রে নিবন্ধিত দলগুলোর মধ্যে একাধিক আসন এবং অনিবন্ধিত দলগুলোর শুধুমাত্র চেয়ারম্যানরাই এগিয়ে থাকবে মনোনয়নে।
ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, নির্বাচনে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন ১৯ নভেম্বর, মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই ২২ নভেম্বর, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার ২৯ নভেম্বর এবং ভোটগ্রহণ ২৩ ডিসেম্বর। এক্ষেত্রে প্রার্থী বাছাই ও জোটগত মনোনয়ন নিশ্চিত করে প্রত্যাহার করার কাজটি দ্রুত শেষ করতে হবে বিএনপিকে। যদিও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোট নির্বাচন এক মাস পিছিয়ে পুনঃতফসিল ঘোষণার দাবি জানিয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও রবিবার (১১ নভেম্বর) সকালে জানিয়েছেন, সবার সঙ্গে আলোচনা করে তফসিল পেছালে আওয়ামী লীগের কোনও আপত্তি নেই।
ঐক্যফ্রন্টের বৈঠকঐক্যফ্রন্ট নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঐক্যফ্রন্টের দলগুলো পরবর্তী বৈঠকের আগে নিজেদের প্রাথমিক প্রার্থী তালিকা প্রস্তুত করবে। ইতোমধ্যে সারাদেশ থেকে দলগুলোর আগ্রহী প্রার্থীরা যোগাযোগ শুরু করেছেন। ঐক্যফ্রন্টে বিএনপির বাইরে বাকি চারটি দল তালিকা প্রস্তুত করার কাজে হাত দিয়েছে। আজকালের মধ্যে ঐক্যফ্রন্টের আসন বণ্টনের বৈঠক হবে।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, ‘আশা করছি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আসন বণ্টনের কাজ শেষ করবো।’ ঐক্যফ্রন্টের আরেক নেতা আবদুল মালেক রতন জানান, ‘আজ (রবিবার, ১১ নভেম্বর) জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের পর নেতারা যার যার মতো চলে যাওয়ায় দ্রুত বসা যায়নি। রবিবার-সোমবারের মধ্যে ঐক্যফ্রন্টের পরবর্তী বৈঠক হতে পারে। সে বৈঠকেই আসনের বিষয়ে আলোচনা শুরু হবে।’
জেএসডির সহ-সভাপতি তানিয়া ফেরদৌসি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আগামী মিটিংয়ে বসে আসনের বিষয়টি চূড়ান্ত করবে। এছাড়া প্রত্যেক দলের তো একটা চাহিদা থাকবে। তবে যেখানে জয়ী হতে পারে এমন প্রার্থীর তালিকাও দেবো আমরা। নির্বাচন যেহেতু জোটগতভাবে হবে, সেক্ষেত্রে সবাই জোটের প্রার্থী হবে। আর জোটের মধ্যে যেসব দলের প্রতীক আছে, তারা চাইলে নিজেদের প্রতীকে নির্বাচন করতে পারবে। তবে যে প্রতীক সবচেয়ে জনপ্রিয় তা তো অগ্রাধিকার পাবে প্রতীক বাছাইয়ের ক্ষেত্রে।’
গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সবেমাত্র তো নির্বাচনে যাওয়া সিদ্ধান্ত হলো। আসন বণ্টন দুই-একদিনের মধ্যে বৈঠক করে ঠিক করা হবে। এক্ষেত্রে নিশ্চয় প্রতিটি দলের একটা চাহিদাপত্র থাকবে। এর আলোকে সমন্বয় করে জোটের বৈঠকে ঠিক করা হবে কোন দল কত আসনে নির্বাচন করবে।’
জোটের মধ্যে যাদের নিবন্ধন আছে, তারা চাইলে নিজ প্রতীকে নির্বাচন করতে পারবে বলেও উল্লেখ করেন সুব্রত চৌধুরী। তিনি বলেন, আর যাদের নিবন্ধন নেই, তারা অন্যদের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করবে। সেক্ষেত্রে ধানের শীষের প্রাধান্য পাওয়াটাই স্বাভাবিক।’ ২০ দলীয় জোটের আটটি দল নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত। দলগুলো হলো, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, খেলাফত মজলিস ও বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বিএমএল)।
বিএনপির বাইরে বাকি দলগুলোর ক্ষেত্রে একাধিক নেতা মনোনয়ন পাবেন বলে দলীয় সূত্র জানায়। এছাড়া অনিবন্ধিত দলগুলোর মধ্যে জামায়াতের বিষয়টি আলাদা। তাদের প্রত্যাশার জায়গা চারদলীয় জোটের সময় থেকেই ভিন্ন গুরুত্ব পেয়েছে।
তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য জানান, জামায়াতের প্রত্যাশা থাকলেও এবার জোটগত সমর্থন দেওয়া হবে কমসংখ্যক আসনে। এলডিপি তিনটি, খেলাফত মজলিস তিনটি, বিজেপি একটি বা দুটি, কল্যাণ পার্টি একটি, জমিয়তের দুই অংশে তিন থেকে পাঁচটি, বিএমএল একটি আসনে জোটগত মনোনয়ন পেতে পারে। এছাড়া জোটের অনিবন্ধিত দলগুলোর মধ্যে দুই-একজন জোটগতভাবে মনোনয়ন পেতে পারেন। এক্ষেত্রে জামায়াতসহ জোটকে প্রায় ৩৫টি আসনে ছাড় দিতে পারে বিএনপি।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ক্ষেত্রে গণফোরামকে তিনটি, জেএসডিকে দুটি, নাগরিক ঐক্যকে দুটি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ তিনটি আসনে জোটগতভাবে মনোনয়ন পেতে পারে। তবে এ বিষয়গুলো এখনও চূড়ান্ত হয়নি। বিএনপির নির্বাচনি কাজে সম্পৃক্ত একটি সূত্র জানায়, জোট ও ঐক্যফ্রন্টের হেভিওয়েট নেতাদের আসন বণ্টনে রাজধানীকে প্রাধান্য দেওয়া হবে।
বিএনপির সূত্রগুলো বলছে, দলের এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের চাহিদা সমন্বয় করা। উভয় জোট মিলে ২৬টি দলের চাহিদা সমন্বয় করে প্রার্থিতা চূড়ান্ত করতে হবে। এছাড়া এই ২৬টি দলের চাহিদা সমন্বয় করার চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি সবচেয়ে বড় সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে খোদ দলেই। কারণ, গত ১০ বছরে প্রত্যেকটি এলাকাতেই একাধিক নেতা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, ‘আসন বণ্টনের বিষয়টি বড় কোনও সমস্যা নয়। এটা নিয়ে কোনও চ্যালেঞ্জের মধ্যেও পড়তে হবে না আশা করি। ছোটখাটো দুই-একটি সমস্যা থাকলে সেগুলো আলোচনা করে সেরে নেবো। আমরা খুব দ্রুত এ বিষয়ে কর্মকৌশল নির্ধারণ করবো।’


শেয়ার করুন