ডেস্ক নিউজঃ
দেশের একমাত্র পাহাড়ি দ্বীপ মহেশখালী। এ উপজেলারই অন্তর্গত কুতুবজোম ইউনিয়নের একটি দ্বীপ সোনাদিয়া। উপজেলার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এ দ্বীপে গাড়িযোগে যাওয়ার সুযোগ নেই। জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভর করে নৌকা কিংবা বোটযোগে যাতায়াত করতে হয়। এ দ্বীপে নেই কোন পুলিশের ক্যাম্প। তাই দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় সোনাদিয়ায় বাস করা শক্তিশালী একগোষ্ঠীর কাছে। সোনাদিয়ার দুইশ’ বছরের ইতিহাসে একপ্রকার ঐ গোষ্ঠীর হাতেই ন্যস্ত দ্বীপের শাসন ক্ষমতা। যে কারণে আধিপত্য বিস্তার, ডাকাতি, জলদস্যুতা, মাছ ও লবণ চাষের ঘের দখল, অস্ত্রশস্ত্র মজুদসহ নানান অপরাধে জড়িত সন্ত্রাসীদের নিরাপদ আবাস্থল হিসেবে গড়ে ওঠে দ্বীপটি। এখান থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা হয় বঙ্গোপসাগরে জলদস্যুতার নেটওয়ার্কও।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৩ সাল থেকে হঠাৎ করেই মানবপাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে সোনাদিয়া দ্বীপের নাম ওঠে আসে। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাচারের জন্য সোনাদিয়া দ্বীপে নারী, পুরুষ ও শিশুদের এনে রাখা হয়। কুতুবজোম কেন্দ্রিক দালাল চক্রের মাধ্যমে মানবপাচারের ব্যবসাটি জমজমাট হয়ে ওঠে। জিম্মি করে মোটা টাকা আদায়ের পর তাদের সাগর পথে লোভনীয় অফার দিয়ে মালয়েশিয়া পাঠানো হয়। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার কারণে ২০২০ সাল থেকে সোনাদিয়া দ্বীপ থেকে মানবপাচারের সংখ্যা কমতে শুরু করে।
এদিকে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, টেকনাফে ওসি প্রদ্বীপ কাণ্ডের পর ইয়াবা ব্যবসায়ীরা তাদের রুট পরিবর্তন করেছে। আগে মায়ানমার থেকে টেকনাফের বিভিন্ন পয়েন্টে ইয়াবা খালাস হলেও ইয়াবা ব্যবসায়ীরা নিরাপদ হিসেবে এখন মহেশখালী এই দ্বীপকে বেছে নিয়েছে। সাগর পথে মহেশখালীতে যে কয়েকটি পয়েন্টে ইয়াবা খালাস হয় তারমধ্যে সোনাদিয়া দ্বীপ অন্যতম। দ্বীপে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত যাতায়াত না থাকায় ইয়াবার চালানগুলো সুবিধামত সময়ে মহেশখালীর বিভিন্ন স্থানে আনা হয়। সেখান থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হয় বলেও নিশ্চিত করেছে সূত্রটি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সোনাদিয়া দ্বীপের এক সময়ের অঘোষিত রাজা ছিল তৎকালীন ইউপি সদস্য আবদুল গফুর প্রকাশ নাগু মেম্বার। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ২০১৩ সালের ৩ জুলায় রাতে নাগু মেম্বারকে নির্মমভাবে হত্যা করে তার আপন ভাইপো জাম্বো ও সরওয়ার গ্রুপ। পরে র্যাবের সাথে বন্দুকযুদ্ধে জাম্বো ও সরওয়ার মারা যান। এর পরপরই ক্ষমতা চলে আসে নাগু মেম্বারের ছেলে নকিবের কাছে। অপরাধীদের মধ্যে বিভিন্ন গ্রুপিং সৃষ্টি হওয়ায় নকিবের নেতৃত্বে সোনাদিয়া দ্বীপের অপরাধী চক্রটি পূর্বের মত সুবিধা করতে পারেনি। এই ফাঁকে মাথাছাড়া দিয়ে উঠে মৃত একলাছ মিয়ার পুত্র একরাম, শাহীন ও মকছুদ, বদি আলমের পুত্র নাগু ও আনজু, মোস্তফা আলীর পুত্র সুমন ও শাহেদ সহ তাদের দলটি। মূলত শাহিনের নেতৃত্বে তারাই সোনাদিয়া দ্বীপের অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ করে।
২০২১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত কুতুবজোম ইউপি নির্বাচনে সোনাদিয়া ওয়ার্ড থেকে একরাম মিয়া ইউপি সদস্য নির্বাচিত হয়। যদিও তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী নুরুল আজিম অভিযোগ করে বলেন, ভোটের দিন দুপুর ১টায় একরামের ভাই শাহীনের নেতৃত্বে একদল অস্ত্রধারী মারধর করে মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে তাদের গ্রাম থেকে বের করে দিয়ে ভোট কেড়ে নেয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সোনাদিয়া দ্বীপের বাসিন্দারা জানান, একরাম মিয়া মেম্বার নির্বাচিত হওয়ার পরপরই তার ভাই শাহীন সোনাদিয়া দ্বীপে নানান অপরাধের নিয়ন্ত্রণকর্তা হিসেবে নেতৃত্ব দেয়া শুরু করে। মহেশখালীর বাইরে থেকে ভাড়াটে ডাকাত এনে শাহীন, মকছুদ, আনজু ও নাগুর নেতৃত্বে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার ট্রলারে ডাকাতি শুরু করে। লুট করা মালামালগুলো তাদের সোর্সের মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গায় নিরাপদে বিক্রি করে। একরাম মেম্বারের নেতৃত্বে তাদের চক্রের সদস্যরা ট্রলারযোগে বার্মা থেকে ইয়াবা এনে দ্বীপে জমা করে। এ চক্রের পাশাপাশি নকিব সিন্ডিকেটও ইয়াবা ব্যবসা চালু রেখেছে।
একটি বিশেষ সূত্র জানায়, গত ১৭ ফেব্রুয়ারি টেকনাফ থেকে ট্রলারযোগে প্রায় ৪ লাখ ইয়াবা নিয়ে আসে কুতুবজোম ইউনিয়নের পূর্বপাড়া গ্রামের ফজলুল হকের পুত্র নবীর হোসেন বদ। সেই ইয়াবা সোনাদিয়া মগচরের দক্ষিণ পশ্চিমে সাগর থেকে লুট করে একরাম মেম্বারের ভাই শাহীনের গ্রুপ। ইয়াবাগুলো নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে প্রথমে সমঝোতা ও পরে দ্বন্দ সৃষ্টি হয়। ইয়াবার মালিক বদ’র ভাই নুর হোসেন সোনাদিয়া পূর্বপাড়ায় বসবাস করার সুবাধে ১২ লাখ টাকার বিনিময়ে ইয়াবাগুলো ফেরত চায়। কিন্তু শাহীন সেই ইয়াবা ফেরত দেয়নি। তখনই বিষয়টি জনসম্মুখে প্রকাশ করে বদ। এ নিয়ে স্থানীয়দের মাঝে বেশ কয়েকদিন আলোচনা-সমালোচনা চলে।
এ বিষয়ে মহেশখালী থানার অফিসার ইনচার্জ মো. আবদুল হাই জানান, মাদকের বিরুদ্ধে পুলিশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এছাড়াও সোনাদিয়া দ্বীপের প্রতি আলাদা নজর রাখা হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে অভিযান চালাতে বেগ পেতে হয়। তারপরেও পুলিশ সর্বোচ্চ তৎপর রয়েছে। পুলিশকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করার জন্য স্থানীয়দের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।