বাড়ছে অপরাধ প্রবণতা খুন, ধর্ষণ: নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ জরুরী

নুর মোহাম্মদ রানা

অপরাধ বলতে সমাজ কর্তৃক শস্তিযোগ্য কোনো অন্যায় আচরণকে বুঝায়। সাধারণত অপরাধ আইন বা দন্ডবিধি উদ্দেশ্যমূলকভাবে লঙ্ঘন করাকে আইনগত দৃষ্টিকোণ হতে অপরাধ বলা হয় এবং এর জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক শাস্তির বিধান রয়েছে। অপরাধের আইনগত সংজ্ঞার একটি বড় সুবিধা হলো এটি অপরাধের সামাজিক সংজ্ঞা হতে অনেক সংক্ষিপ্ত ও দ্ব্যর্থক।

সুতরাং আইনগত সংজ্ঞানুযায়ী- (ক) অপরাধ হচ্ছে এক ধরনের আচরণ এবং (খ) ওই আচরণটি বিদ্যমান অপরাধ আইনকে অমান্য করে। এ সংজ্ঞার একটি বড় দুর্বলতা হচ্ছে সমাজের জটিল সমস্যাকে আড়াল করা হয়। কেননা কোনো সমাজই চিরস্থির নয়। আসলে প্রতিনিয়ত সমাজ পরিবর্তিত হচ্ছে।

একইভাবে অপরাধ প্রবণতা ও এর ধরনও প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। আবার সমাজভেদে অপরাধ আচরণের ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। যেমন সিঙ্গাপুরে চুইংগাম বিক্রি করা একটি অবৈধ কাজ কিন্তু আমেরিকানদের কাছে তা অচিন্তনীয়। সুতরাং অপরাধ সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ ধারণা পেতে হলে একটি বিশেষ সমাজ কোনো কাজগুলোকে অপরাধ হিসাবে বিচার করে তা দেখা অপরিহার্য।

এছাড়াও সামাজিক সংজ্ঞানুসারে সমাজে প্রচলিত আদর্শসমূহের যে কোনো লঙ্ঘণকে অপরাধ বলে। অর্থাৎ অপরাধ সমাজ বিরোধী কাজ। মানুষের মধ্যে কিছু মানবীয় আচরণ আছে যা অপরাধ আইনের পরিপন্থী নয় কিন্তু সামাজিকভাবে নিন্দনীয় বা সামাজিক রীতিনীতি, প্রথা বা অনুশাসনের পরিপন্থী। ফলে তা সামাজিকভাবে ঘৃণিত ও দন্ডনীয়। এমতাবস্থায় অপরাধ প্রবণতা বা অপরাধ সংঘটিত হওয়া কারো কাম্য নয়। তদুপরি আদিম যুগ থেকেই মানুষের মধ্যে নৃশংসতা ও বর্বরতা ছিল।

সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে তা নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়াস চালানো হয়। যদিও মানুষ সভ্যতার মুখোশ পরে আছে। মানুষের অমানবিক আচরণগুলো মূলত তার পাশবিক প্রবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ। জন্মগত পাশবিক প্রবৃত্তিগুলো পারিপার্শ্বিকতার কারণে জাগ্রত হয়। কমবেশি পশুত্ব স্বভাব প্রত্যেক মানুষের মধ্যে রয়ে গেছে। জাতি-গোষ্ঠী, শ্রেণি-লিঙ্গ, অর্থনৈতিক বৈষম্য, না পাওয়ার অতৃপ্তি ও ঘৃণা মানুষের স্বাভাবিক সহজাত প্রবৃত্তিকে বাধাগ্রস্ত করে।

বিশ্লেষণে দেখা যায় মানুষের অপরাধ প্রবণতা ও নিষ্ঠুরতা সমাজে আগেও ছিল। এখন এর ভিন্ন আকারের চরম বহিঃ প্রকাশ ঘটছে। মানুষের পাশবিকতার যে বহিঃপ্রকাশ ঘটছে, তা এক দিনে তৈরি হয়নি। আগে কোনো অপরাধ করলে সমাজে জবাবদিহি করতে হতো। এখন কোথাও তা করতে হয় না। অন্যায়-অপরাধ করে দিনের পর দিন অপরাধীরা অনায়াসে পার পেয়ে যায়। এতে মানুষের মধ্যে ভীষণ হতাশা তৈরি হয়।

একজন নিরাশ মানুষ নিজের হতাশাকে কাটাতে, নিজের অপ্রাপ্তিবোধের তাড়না থেকে নিজের চেয়ে দুর্বল কাউকে বেছে নিয়ে তার ওপর হিংস্রতা দেখিয়ে একধরনের মানসিক পরিপূর্ণতা লাভ করতে চায়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সমাজে অপরাধপ্রবণতা বাড়ে। পক্ষান্তরে মানুষ যখন দেখবে, অপরাধ করে পার পাওয়া যায় না, তখন অন্যায় পথে পা বাড়াতে সাহস পাবে না।

তখন সমাজে অপরাধ করার প্রবণতা কমে আসবে। সভ্য সমাজে কোমলমতি শিশু ও অসহায় নারী নির্যাতনসহ তুচ্ছ কারণে খুনখারাবি, নৃশংসতা, বর্বরতা ও নির্মমতার ঘটনা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে! সমাজ জীবনে মানুষ কেন এমন জঘন্য অপরাধমূলক কর্মকান্ড ঘটাচ্ছে, কেন পশুর মতো এতটা হিংস্র ও নৃশংস হয়ে উঠছে? কেনই-বা মানুষ নিজের ‘মান’ আর ‘হুঁশ’ হারিয়ে অমানুষ হয়ে যায় তা এখন ভাবিয়ে তুলছে সকলকে।

মানবাধিকার ও সমাজকর্মী, অপরাধ বিশ্লেষক, মনোবিজ্ঞানী, আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা এসব নৃশংসতার জন্য দোষী ব্যক্তিদের যথাসময়ে বিচারের মুখোমুখি করতে না পারাকে দায়ী করছেন; একই সঙ্গে তাঁরা ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব, সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়কেও দোষারোপ করছেন।

যদিও সীমা লঙ্ঘনকারী মানুষকে সাবধান করে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের পূর্বে বহু মানবগোষ্ঠীকে আমি ধ্বংস করেছি, যখন তারা সীমা অতিক্রম করেছিল। স্পষ্ট নিদর্শনসহ তাদের কাছে তাদের রাসুল এসেছিল, কিন্তু তারা বিশ্বাস করার জন্য প্রস্তুত ছিল না। এভাবে আমি অপরাধী সম্প্রদায়কে প্রতিফল দিয়ে থাকি।’ অথচ ধর্ম-কর্ম ভুলে ক্ষুদ্র, তুচ্ছ কারণে সমাজে যত বীভৎস ঘটনা ঘটছে, কয়েক বছর আগে তা ছিল না।

এ ব্যাপারে বর্তমানে গণমাধ্যম অনেক সোচ্চার বলে ঘটনাগুলো বেশি আলোচিত হচ্ছে। ব্যক্তিগত আর সামষ্টিক মূল্যবোধের মধ্যে সংঘাত সব সময় রয়েছে। প্রতিটি বীভৎস ঘটনাকে তাই আলাদাভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে যাদের মধ্যে ধর্মীয় নীতি-নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ কম, তাদের এই বার্তা দিতে হবে। আর অপরাধ করলে সাজা নিশ্চিত করতে হবে। সম্প্রতি ভাবনার বিষয় হল ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় মানবিক মূল্যবোধের আজ দারুণ সংকট।

সমাজের সর্বস্তরে নৈতিক আধ্যাত্মিক, দার্শনিক ও ধার্মিক চিন্তা-চেতনার পরিবর্তে আস্থাহীনতা, অমানবিকতা, অসভ্যতার মাত্রা দিন দিন বেড়ে চলেছে। কৃত্রিমতা, চাতুরতা, স্বার্থপরতা, তিক্ততা, হীনমন্যতা, ঈর্ষা, ক্রোধ, অহমিকা, দাম্ভিকতা, অনাচার অবিচার, অকৃতজ্ঞতা, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, বেলাল্লাপনা, যৌনাচার, অবিচার, অমিতাচার, নৃসংসতা, বারবনিতা, বহুগামিতা, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, অত্যাচার, ষড়যন্ত্র, খুন, গুম, অপহরণ, পণ আদায়, ঠকবাজী, প্রতারণা, সুদ, ঘুষ, মদ, জুয়া, যৌতুক, মাদক, বাল্যবিবাহ, চোরাচালানী, মজুদখোরী, ব্লু-ফিল্ম, পর্ণসাহিত্য, বিজাতীয়, আকাশ সংস্কৃতির অবাধচর্চা, অমিতাচার, পরকীয়া, ঝগড়া, কলহ, বিরোধ, গোপনে অবৈধ মেলামেশা, ইভটিজিং, এসিড নিক্ষেপ, নারী ও শিশু ধর্ষণ, শিশু খাদ্যে বিষক্রিয়া, চাঁদাবাজী, বোমাবাজী, কোচিং ব্যবসা, সাইবার ক্রাইম, সাইবার, মসজিদ, মন্দির, উপাসনালয়ে হামলা, হত্যা, দান বাক্স ও জুতা চুরি ইত্যাদি অনৈতিক কর্মকান্ড সামাজিক নিরাপদ পরিবেশকে মারাত্তকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করছে। এর ফলে স্বস্থি, শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে।

উদ্ধিঘ্ন হওয়ার বিষয় হল পিতা-মাতা কর্তৃক সন্তান ও সন্তান কর্তৃক পিতা-মাতা হত্যার মত ন্যাক্কার ও কলঙ্কজনক ঘটনা ঘটছে এদেশে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের সেঞ্চুরী থেকে চলন্ত ট্রেন, চলন্ত বাসে আগামি দিনের কর্ণধার শিক্ষার্থীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের হত্যার পর লাশের উপর নৃত্য করা হচ্ছে। শিশুদের ও নারীদের উপর চলছে নির্যাতনের মহড়া। সর্বত্র ভীতি, আতঙ্ক, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর অনিরাপত্তার মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করছি আমরা। হতাশ হয়ে পড়ছে সুশীল সমাজ, সাদা মনের মানুষ, সমাজ বিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, অভিজ্ঞ মহল, মানবতাবাদী, পরিবেশবাদী আর সেই সাথে এদেশের নাগরিকরা। কারণ একটির পর একটি বীভৎস ঘটনা ঘটেই চলেছে। ম্লা করে দিচ্ছে অতীতের বীভৎস রেকর্ড। সব মিলিয়ে গোটা সমাজ ব্যবস্থায় নেমে এসেছে এক চরম হতাশা, অমানিষার অন্ধকার ও ক্রান্তিকাল।

প্রতিদিন খবরের কাগজে ও সার্বক্ষণিক ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াগুলোতে আমরা যা দেখছি তা সমাজ উন্নয়ন ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার বিপরীতে সমাজ ব্যবস্থায় চরম অবনতি ও অবক্ষয়ের খবরা খবরের পরিমাণ বেশি। দেশের নানা স্থানে ঘটে যাওয়া পৈশাসিক, আতঙ্কিত, নিষ্ঠুর, লোমহর্ষক, বীভৎস সংবাদগুলো জাতির বিবেককে মারাত্মকভাবে আহত করছে। মানবতা ও মানবাধিকারের হালচিত্র দেখে মনে হয় আমরা এ কোন যুগে আছি।

এ অবক্ষয় থেকে মুক্তির উপায় বের করার জন্য উচ্চতর গবেষণা জরিপ ও পর্যবেক্ষণ করার এখনি সময়। কারণ কি কি কারণে সামাজিক অবক্ষয় ঘটছে, কারা এর জন্য দায়ী, কি উপায়ে এর প্রতিকার সম্ভব, এ বিষয়ে প্রথমে রাষ্ট্রের কর্ণধাদের এগিয়ে আসতে হবে, সেই সাথে এগিয়ে আসতে হবে দেশের সুশীল সমাজ, সাদা মনের মানুষ, সমাজ বিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, মানবতাবাদী, পরিবেশবাদী সংশি¬ষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ মহল, দেশি- বিদেশি স্বেচ্ছাসেবি সংস্থা, মানবাধিকার প্রবক্তা, সাংবাদিক, গবেষক, দার্শনিক, ধর্মীয় নেতাসহ সর্বস্তরের প্রসাশনিক কর্মকর্তা, সামরিক বাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, আনসার-ভিডিপি এবং সর্বপরি রাষ্ট্রযন্ত্র ও সর্বস্তরের গণমানুষকে।

তাহলে হয়তো সামাজিক অবক্ষয়ের মাত্রা কমিয়ে এদেশকে মহা দুর্যোগ থেকে বাঁচানো সম্ভব। তা নাহলে দেশের ভবিষ্যৎ পরিণতি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। ভূলুণ্ঠিত হবে মানবিক মূল্যবোধ।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, সাংবাদিক।


শেয়ার করুন