ফেনী নদী থেকে ভারতকে পানি দিল বাংলাদেশ

শুকনো মৌসুমে নিজের পানির সংকট থাকলেও নিকটতম বন্ধু ও প্রতিবেশী ভারতের জনগণের খাবারের পানি সংকট দূর করতে ফেনী নদী থেকে পানি দিচ্ছে বাংলাদেশ। গতকাল শনিবার নয়াদিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে এবং বৈঠকের পর এ বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়েছে।

ওই এমওইউর আওতায় দুই দেশের অভিন্ন ফেনী নদী থেকে ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি তুলে নেবে ভারত। তিস্তার মতো ফেনী নদীর পানিবণ্টন চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত হলেও তা ২০১১ সাল থেকে ঝুলে আছে। ত্রিপুরা রাজ্যের সাবরুম শহরে খাবারের পানি সংকট মোকাবেলায় নেওয়া প্রকল্পের জন্য ভারত ফেনী নদী থেকে পানি তোলার ব্যাপারে বাংলাদেশের সম্মতির অনুরোধ জানিয়ে আসছিল। ইস্যুটি বেশ কয়েক বছর ধরে ঝুলে থাকার পর বাংলাদেশ গতকাল শনিবার এ বিষয়ে সম্মতি দিয়েছে। তবে গত আগস্ট মাসে ঢাকায় দুই দেশের যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) সচিব পর্যায়ের বৈঠকেই ফেনী নদী থেকে ভারতকে পানি দেওয়ার বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত হয়েছিল বলে জানা গেছে।

গতকালের বৈঠকে বাংলাদেশ প্রায় ৯ বছর ধরে ঝুলে থাকা তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির প্রসঙ্গ তুলেছে। ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা সব পক্ষের মত নিয়ে তিস্তা চুক্তি সই করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। বৈঠকের পর রাখা বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিংবা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি—কেউই তিস্তা বা কোনো নদীর পানিবণ্টন নিয়ে কথা বলেননি। তবে দুই দেশের যৌথ বিবৃতিতে ভারতের চেষ্টার কথা উল্লেখ রয়েছে।

জানা গেছে, এর আগে চূড়ান্ত হওয়া ফেনী নদীর পানিবণ্টন চুক্তির খসড়া অনুযায়ীই আগামী দিনে চুক্তি করার ব্যাপারে গতকালের বৈঠকে উভয় পক্ষ মত দিয়েছে। এর বাইরে মনু, মুহুরি, খোয়াই, গোমতী, ধরলা ও দুধকুমার—এই ছয়টি নদীর পানিবণ্টনে অন্তর্বর্তী চুক্তি সইয়ের জন্য জেআরসির কারিগরি কমিটিকে দ্রুত তথ্য-উপাত্ত বিনিময় ও চুক্তির খসড়া প্রস্তুত করতে শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি তাগিদ দিয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকায় যত দ্রুত সম্ভব ফেনীসহ মোট সাতটি নদীর পানিবণ্টন চুক্তি দ্রুত সই করার ব্যাপারে দুই দেশ একমত হয়েছে। আগামী দিনে দুই দেশের মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ের সফরে, বিশেষ করে আগামী বছরের মার্চ মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সম্ভাব্য বাংলাদেশ সফরে এ বিষয়ে অগ্রগতি হতে পারে।

গতকালের বৈঠকে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ভারতের ব্যবহারের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে। জানা গেছে, এ বিষয়ে একটি চুক্তি দুই দেশের মধ্যে আগেই হয়েছিল। গতকাল সেই চুক্তি বাস্তবায়নে ‘স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি)’ সই হয়েছে। ফলে আগামী দিনগুলোতে ভারত এই বন্দর দুটি ব্যবহার করে নির্ধারিত মাসুল দিয়ে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পণ্য আনা নেওয়া করতে পারবে।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আসামে নাগরিক তালিকা (এনআরসি) প্রসঙ্গটি তুলেছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে এনআরসি প্রক্রিয়া পরিচালনা করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রক্রিয়া যত দিন না শেষ হচ্ছে তত দিন বাংলাদেশের উদ্বেগের কোনো কারণ নেই।

প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা সংকটের কথা তুলে ধরে ভারতের সহযোগিতা চান। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তাঁর দেশও চায় রোহিঙ্গারা দ্রুত, নিরাপদ ও টেকসইভাবে ফিরে যাক। ফিরে যাওয়ার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে ভারত মিয়ানমারের রাখাইনে ঘর নির্মাণ করে দিয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য ভারত পঞ্চমবারের মতো মানবিক সহযোগিতা পাঠাবে।

শীর্ষ বৈঠকে উভয় নেতাই পরস্পরের সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান, সমতা, বোঝাপড়া ও সহযোগিতার ভিত্তিতে বিদ্যমান সম্পর্কে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। দুই দেশের সম্পর্ক ‘স্ট্র্যাটেজিক’ মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে বলে তাঁরা মনে করেন। নরেন্দ মোদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমৃদ্ধ, শান্তিপূর্ণ ও উন্নত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে পূর্ণ সহযোগিতার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন। এই অঞ্চলে শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে শেখ হাসিনার নিরলস প্রচেষ্টা এবং সন্ত্রাসের ব্যাপারে তাঁর কোনো ধরনের ছাড় না দেওয়ার নীতির প্রশংসা করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।

উভয় পক্ষই দুই দেশের মধ্যে যাতায়াত সহজ করার ওপর জোর দিয়েছেন। শেখ হাসিনা বাংলাদেশিদের ভারতে যাতায়াতের ক্ষেত্রে যেকোনো বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দেওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেছেন। উভয় পক্ষই একমত হয়েছে, বাংলাদেশ ও ভারতের ভিসা নিয়ে দুই দেশের যেকোনো বন্দর দিয়ে যাতায়াতের ক্ষেত্রে অবশিষ্ট যে বিধিনিষেধ আছে সেগুলো পর্যায়ক্রমে উঠে যাবে। আখাউড়া ও গজলডোবা (পশ্চিমবঙ্গ) দিয়েই এটি শুরু হবে। উল্লেখ্য বাংলাদেশিদের জন্য ভারতীয় ভিসায় কোন বন্দর ব্যবহার করে আসা-যাওয়া করা যাবে তা নির্দিষ্ট থাকে।

সীমান্তে মৃত্যুর বিষয়টিও বৈঠকে উঠেছে। বৈঠক শেষে ৫৩ দফা যৌথ বিবৃতির একটি অংশে বলা হয়েছে, সীমান্তে প্রাণহানির সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে উভয় নেতাই সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা খাতেও উভয় পক্ষ সহযোগিতা জোরদারে আগ্রহ প্রকাশ করে দ্রুত এ বিষয়ে একটি এমওইউ সইয়ের তাগিদ দিয়েছেন।

বৈঠকে বাংলাদেশ ও ভারত সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারি চুক্তি করতে দ্রুত একটি যৌথ সমীক্ষা চালাতেও রাজি হয়েছে। আখাউড়া-আগরতলা বন্দর দিয়ে পণ্য আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধ তুলে নিতে ভারত অনুরোধ জানালে বাংলাদেশ বলেছে, অদূর ভবিষ্যতে বেশির ভাগ গতানুগতিক পণ্য বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ওই বিধি-নিষেধ তুলে নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ ভারতকে বাংলাদেশি পাটসহ অন্যান্য পণ্যের ওপর থেকে ‘অ্যান্টি ডাম্পিং’/‘অ্যান্টি সারকামভেনশন’ শুল্ক তুলে নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে। জবাবে ভারত বলেছে, বিষয়টি সুরাহা করতে কাজ চলছে। দুই দেশের শীর্ষ নেতারা দ্রুত ১২টি সীমান্ত হাট চালুর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছেন। এ ছাড়া তাঁরা পাট ও বস্ত্র খাতে সমন্বয় জোরদারে দুই দেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে দ্রুত এমওইউ সইয়ের ওপর জোর দিয়েছেন।

বৈঠকে উভয় নেতা দুই দেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথে কার্গো ও উপকূলীয় জাহাজ চলাচলের বিশাল সম্ভাবনা বাস্তবায়নে জোর দিয়েছেন। ‘প্রটোকল অন ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রানজিট অ্যান্ড টেডের (পিআইডাব্লিউটিটি)’ আওতায় তাঁরা দাউদকান্দি-সোনামুরা রুটসহ ধুলিয়ান-গদাগারি-রাজশাহী-দৌলতদিয়া-আরিচা রুটে (আসা-যাওয়া) পণ্য আনা-নেওয়ার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন।

শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালের (বিবিআইএন) মধ্যে মোটরযান চলাচল চুক্তি দ্রুত বাস্তবায়নে কাজ করতে সম্মত হয়েছেন। তাঁরা ঢাকা-শিলিগুড়ির মধ্যে সরাসরি বাস চালুর পরিকল্পনাকে স্বাগত জানিয়েছেন।

উভয় নেতাই প্রস্তাবিত গঙ্গা-পদ্মা ব্যারাজ প্রকল্প নিয়ে সমীক্ষা চালানোর ব্যাপারে যৌথ কারিগরি কমিটি গঠন ও কারিগরি কমিটির সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁরা রেল যোগাযোগ খাতে সহযোগিতার সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেন এবং ঢাকা ও কলকাতার মধ্যে চলাচলকারী মৈত্রী এক্সপ্রেসের কার্যক্রম সপ্তাহে চার দিন থেকে বাড়িয়ে পাঁচ দিন এবং খুলনা ও কলকাতার মধ্যে চলাচলকারী বন্ধন এক্সপ্রেস সপ্তাহে এক দিন থেকে বাড়িয়ে দুই দিন করার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান। দুই দেশের মধ্যে চলাচলকারী ফ্লাইট সংখ্যা প্রতি সপ্তাহে ৬১টি থেকে এবারের গ্রীষ্মে ৯১টি এবং আগামী বছরের শীতে ১২০টিতে উন্নীত হওয়ার সিদ্ধান্তকে তাঁরা স্বাগত জানান।

বৈঠকে উভয় নেতাই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে যৌথ ভূমিকার আলোকে প্রতিরক্ষা খাতে সহযোগিতা জোরদারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। সমুদ্র নিরাপত্তা খাতে নিবিড় অংশীদারিকে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি তাঁরা বাংলাদেশের উপকূলীয় নজরদারি রাডার ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগকে স্বাগত জানান। জানা গেছে, এই ব্যবস্থা চালু হলে সাগরে কত সংখ্যক জাহাজ আছে এবং কোনদিকে সেগুলো যাচ্ছে সে বিষয়ে আরো স্পষ্ট ধারণা পাওয়া সম্ভব হবে। উভয় নেতাই ভারতের দেওয়া ৫০ কোটি ডলার প্রতিরক্ষা ঋণ দ্রুত কাজে লাগাতেও সম্মত হয়েছেন।

শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি ভারতের দেওয়া ঋণ দ্রুত কাজে লাগাতে এক্সিম ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার প্রতিনিধির অফিস খোলার ব্যাপারে কাঠামো চুক্তিতে সন্তোষ প্রকাশ করেন। বৈঠকে বিদ্যুৎখাতে সহযোগিতা, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক খাতে বিনিময় নিয়েও আলোচনা হয়েছে। উভয় নেতাই দুই দেশের সার্টিফিকেটকে পারস্পরিক স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে দ্রুত এমওইউ সই করার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছেন।

উভয় দেশ এ বছর মহাত্মা গান্ধীর দেড়শতম জন্মবার্ষিকী, আগামী বছর বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ৫০তম বার্ষিকীতে সাংস্কৃতিক সহযোগিতা ও বিনিময় কর্মসূচি গ্রহণ এবং আগামী বছর বাংলাদেশে-ভারতীয় চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজনে রাজি হয়েছে। দুই শীর্ষ নেতা দুই দেশের জাতীয় জাদুঘরের মধ্যে সহযোগিতার জন্য এমওইউ চূড়ান্ত করতেও সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছেন।

ভারতের চেন্নাইয়ে বাংলাদেশের উপহাইকমিশন খোলার অনুমতি দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। বিমসটেকসহ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিসরে একসঙ্গে কাজ করার ব্যাপারে উভয় নেতা তাঁদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
–সূত্র কালেরকণ্ঠ


শেয়ার করুন