কাঙ্খিত উন্নয়নে বড় প্রতিবন্ধকতা দুর্নীতি

নুর মোহাম্মদ রানা :

রাষ্ট্রীয় বা সরকারি পদ-পদবি ব্যবহার করে ব্যক্তিগত সুবিধা গ্রহণই দুর্নীতি। আরো সহজ করে বলা যায়, নীতির বাইরে যা তা-ই দুর্নীতি। ইতিহাসের আলোকে বলা যায়, বাংলাদেশ তথা এ উপমহাদেশে দুর্নীতি প্রাচীন ও মধ্য যুগে এবং আধুনিক যুগেও ছিল; এখনো দেশে দেশে তা আছে। প্রশ্নটি শুধু দুর্নীতির ব্যাপ্তি-পরিধি কিংবা এর মাত্রা নিয়ে নয়।

শুধু স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে নয়, পাকিস্থান আমলেও দুর্নীতি নিয়ে সে সময়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা, সভা-সেমিনার ও বক্তৃতা-বিবৃতি হয়েছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের আগে ২৪ বছরের পাকিস্থানি শাসন ও শোষণের জাঁতাকলে এ দেশের জনসাধারণ পিষ্ট হয়েছে। দীর্ঘদিন তারা সীমাহীন অত্যাচার, নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকার হয়েছে। আর এ সবকিছুর বিরুদ্ধেই তো ছিল বাঙালির প্রতিবাদ, সংগ্রাম, আন্দোলন ও যুদ্ধ। তবে লক্ষ করার বিষয়, শাসকগোষ্ঠী কিংবা সমাজের দুর্নীতির বিষয়টি এ সময়ে এমন ভয়াবহ রূপ ধারণ করেনি।

দুর্নীতির ভয়াবহ রূপটি দেশের মানুষ দেখতে পায় স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকে, যা আজও অব্যাহত আছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সব সময় ছিলেন খুবই সোচ্চার। ঘাতকদের হাতে নৃশংসভাবে সপরিবারে খুন হওয়ার এক মাস আগে ১০ জুলাই ১৯৭৫ বঙ্গভবনে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণে দুর্নীতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘কেবল পয়সা খাইলেই দুর্নীতি হয় না।’

বিবেকের বিরুদ্ধে কাজ করা যেমন দুর্নীতি, কাজে ফাঁকি দেওয়াও তেমনি দুর্নীতি। একইভাবে নিচের অফিসারদের কাজ না দেখাটাও দুর্নীতি।’ ‘শুধু দুর্নীতি বন্ধ করতে পারলে মানুষের শতকরা ৩০ ভাগ দুঃখ-দুর্দশা লাঘব হবে।’ সেইদিন তিনি আরো বলেন, ‘আপনারা যদি আজকে বলেন যে আমরা কেবল দুর্নীতির ঊর্ধ্বে থাকব, তাহলে এক বছরে বাংলার চেহারার অনেক পরিবর্তন হবে।’ আর দুর্নীতি হলো এক ধরনের সামাজিক সমস্যা।

এ সামাজিক সমস্যাটি কেবল ব্যক্তি জীবনকেই দুর্বল করে সামাজিক সংহতি নষ্ট করে না বরং জাতীয় উন্নয়ন তথা নাগরিকের সার্বজনীন মৌলিক অধিকার পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। দুর্নীতি মূলত সামাজিক রীতিনীতি ও নিয়ম-কানুনের শিথিলতার ফলে উদ্ভূত এমন এক পরিস্থিতি, যা সামাজিক প্রগতির পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। এটি সাধারণত অর্থনৈতিক দুরবস্থা, বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং আইনের অপপ্রয়োগ থেকেই সৃষ্টি হয়। তাই এর পেছনে কোন আইনগত কিংবা নৈতিক সমর্থন থাকে না।

প্রশাসন যন্ত্রের কার্যকারিতার গতি ঘর্ষণমুক্ত ও দ্রুত করার জন্য উৎকোচ গ্রহণ, ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বজনপ্রীতি ইত্যাদি ছোট দুর্নীতির উদাহরণ এবং বড় দুর্নীতির ক্ষেত্রসমূহ হলো সামরিক বিমান, জাহাজ, রসদ, পরিবহন ও যোগাযোগ যন্ত্র, মহাসড়ক বাঁধ, সেতু ইত্যাদি প্রকৌশলী উদ্যোগ, রাষ্ট্রীয ভিত্তিতে ভোগ্যপণ্য ক্রয় বিক্রয, স্কুলের পাঠ্যপুস্তক, হাসপাতালে ওষুধ ও যন্ত্রপাতি সরবরাহ এবং পরামর্শকের ফি ইত্যাদি। এভাবেই ব্যক্তিগত লাভের উদ্দেশ্যেই সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে অন্যায় উদ্দেশ্যে, অপ্রাসঙ্গিক বিবেচনায় ও অযৌক্তিকভাবে সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকার লোকসান করা হয় অথচ এ লোকসান বন্ধ করে জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ করে বাংলাদেশকে সহসাই উন্নয়নের মডেল তৈরি করা যায়।

দুর্নীতির কারণ চিহ্নিত করতে গিয়ে বিশেষজ্ঞরা নানা মত দেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণ হল-দরিদ্রতা, লোভ এবং রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন। বলা হয় দারিদ্র্যের কারণে অনেকে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়।

বাস্তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, রাষ্ট্রীয় উচ্চপদাধিকারী, শিক্ষিত, ব্যবসায়ী, রাজনীতিক এবং সামাজিক, অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরাই অধিক দুর্নীতিগ্রস্ত। এই উচ্চবিত্তদের দুর্নীতি যে দারিদ্র্য বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় কারণ ও দুর্নীতি বিমোচনে প্রধান অন্তরায় তাতে সন্দেহ নেই। দুর্নীতির প্রকোপ এতো ব্যাপক ও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নাগরিক অধিকারগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না, তাই হরহামেশাই বলা হচ্ছে দুর্নীতির কারণেই আইন-শৃঙ্খলার অবনতিতে অপরাধ বৃদ্ধির দরুন জনসাধারণের মৌলিক অধিকার আজ বিপন্ন; ফলে লাঞ্ছিত হচ্ছে মানবতা, পদদলিত হচ্ছে দেশের মর্যাদা। কেননা কালো অর্থনীতি কখনোই উন্নয়নমূলক কর্মকা-ে সহায়ক তো নয় বরং প্রতিবন্ধক।

সমীক্ষা অনুসারে দুর্নীতির এ দুষ্ট চক্রে বছরে ৬০০০০ কোটি টাকার কালো অর্থনীতির সৃষ্টি হয় যা জাতীয় আয়ের এক-তৃতীয়াংশ। অথচ এ অংশ কোন উৎপাদনশীল খাত বা উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে বিনিয়োগ করা সম্ভব হয় না। এ বলয়ে যাদের অবস্থান তারাই আবার ৩০০০০ কোটি টাকার ঋণখেলাপি। এরাই বছরে ১১০০০ কোটি টাকার দুর্নীতিতে জড়িত। এরাই বছরে কমপক্ষে ২০০০০ কোটি টাকার সমপরিমাণ মুদ্রা পাচার করে। এরাই আবার রাষ্ট্র ক্ষমতাকে ব্যবহার করে সরকারকেও ঋণ খেলাপিতে রূপান্তরিত করে। যার কারণে রাষ্ট্রও হয়ে যায় দুর্নীতিগ্রস্থ। অথচ দেখাযায় ৭০ ভাগ গ্রামীণ জনগোষ্ঠী দুর্নীতি করে না। আর এ রকম দুর্নীতির ফলে রাষ্ট্রে বিদেশী বিনিয়োগ কমে আসে যা জাতীয় আয়ে প্রভাব ফেলে।

সরকার, রাষ্ট্র পরিচালনার একমাত্র উপাদান। জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত সরকার জনগণেরই ভাবনাগুলোকে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করে। কিন্তু সরকার পরিচালনার এ কাঠামোদি যদি কোন দুর্বৃত্তায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে সংগঠিত হয় তাহলে তাতে জনগণের ইচ্ছার অপমৃত্যু হয় যা পরোক্ষভাবে অনুন্নয়নের গতিকেই ত্বরান্বিত করে। কেননা এখানে সামষ্টিক স্বার্থ অপেক্ষা ব্যক্তি স্বার্থই প্রাধান্য পায় বেশি। আর এই অবস্থায় দাতাগোষ্ঠী দেশ ও সংস্থাসমূহকে উন্নয়নমূলক কর্মকা- থেকে মুখ ফেরাতে বাধ্য করে। এতে করে দেশের অর্থনীতির অবস্থা মুখ থুবড়ে পড়ে থাকার শামিল হয়ে উঠে।

কোন রাজনৈতিক দলের আয়ের উৎস এবং ব্যয়ের খাত কারো কাছে স্পষ্ট নয়। দেশী বিদেশী বিনিয়োগ জনসমষ্টির একটি অংশের কর্মসংস্থানে সাহায্য করে। এতেকরে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত এক ধরনের উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের সূচনা হয়। দুর্নীতি দেশী বিদেশী বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করে। যাতে করে জনগণ বিনিয়োগের সুফল থেকে বঞ্চিত হয়। আসলে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতেই ঢুকেছে দুর্নীতি। আর তাই দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক কাঠামোর আর যাই হোক সার্বজনীন উন্নয়নকে নিশ্চিত করা যায় না। কেননা যে পরিমাণ অর্থ দিয়ে উন্নয়ন করা যায় তার চেয়ে বেশি পরিমাণ অর্থ কেবল অপচয়ই হয় দুর্নীতির কারণে।

এছাড়াও আমাদের সমাজ ব্যবস্থার নানা ধরনের দুর্নীতি রয়েছে। বড় বড় আমলা মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে অফিসের কেরাণী দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। যার ফলে উন্নয়ন যাত্রা ব্যাহত হচ্ছে নানাভাবে। দুর্নীতির ফলে ব্যক্তিগত উন্নয়ন ও স্বার্থ হাসিল হলেও তা সমষ্টিক উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

সার্বজনীন উন্নয়নের উদ্দেশ্যে লগ্নিকৃত অর্থ যখন ব্যষ্টিক কাজে লাগানো হয় অবৈধ, পন্থায় তখন আর উন্নয়নের সুফল পাওয়া যায় না। ফলে উন্ননের ধারা হয়ে তাকে ব্যাহত। আর এই ব্যাহত উন্নয়নের ধারা সামগ্রিক তথা জাতীয় জীবনে নিয়ে আসে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। বাংলাদেশের দুর্নীতির গল্প ঠিক আরব্য রজনীর গল্পের মতো। রাত ফুরিয়ে ভোর হবে কিন্তু সীমাহীন দুর্নীতির গল্প যেন শেষ হওয়ার নয়, আর এ দুর্নীতি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার অন্যতম অন্তরায়।

বর্তমানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, দুর্নীতি একটি বহুমাত্রিক ব্যাধি। পেশিশক্তির ব্যবহার ও অপরাধের শিকড় হচ্ছে দুর্নীতি। ফলে রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনে অবক্ষয় বা পচন শুরু হয় এবং অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও প্রশাসনসহ কোনো ক্ষেত্রেই সঠিকভাবে লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয় না।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মাত্র কিছুসংখ্যক মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের প্রয়োজনে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি। কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর ও মেহনতি মানুষের মুক্তিই ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল দর্শন। দেশে আজ যে ধনিক শ্রেণী সৃষ্টি হয়েছে, তারা প্রধানত সাধারণ মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান করছেন।

গরিব-দুঃখী ও অসহায় মানুষের কল্যাণের কথা সবারই ভাবতে হবে। শোষকদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে না পারলে এবং তাদের স্বার্থে রাষ্ট্রে পরিচালিত হলে গরিব-দুঃখী ও অসহায় মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন সম্ভব নয়। জনগণের বিরাট অংশ মনে করে, শেখ হাসিনার সদিচ্ছার কোনো ঘাটতি নেই এবং নিষ্ঠার সাথে তিনি কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। কিন্তু শোষক শ্রেণীর বঞ্চনা থেকে জনগণকে মুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না।

দুর্নীতি প্রকৃত উন্নয়নের প্রতিপক্ষ। দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে না পারলে, উন্নয়ন তৎপরতার গতি থমকে যাবে। তাই, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করতে হবে। দুর্নীতি আজ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আইনের প্রয়োগে কঠোরতা অবলম্বন ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।

নুর মোহাম্মদ রানা
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, সাংবাদিক


শেয়ার করুন